মরে গেলেই হয়ত বেঁচে যাবো!

Share

মনে পড়ে কনফিউজড শুভর কথা? তার এইচ.এস.সি. পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে গতকাল। তার অনেক বন্ধুরা এ প্লাস পেলেও তার এ প্লাস আসেনি। এ নিয়ে বাবা মায়ের বকাঝকার শেষ নেই। সারাবছর খোঁজ না থাকলেও আজ অনেক আত্মীয় স্বজনই ফোন দিয়ে তার রেজাল্টের খবর নিচ্ছেন। এই এ-প্লাস না পাওয়ার ব্যর্থতাতেই অসহ্য মনে হচ্ছে জীবনটাকে।
দুই মাস পরের কথা, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির এ্যাডমিশন টেস্ট দেবার পরেও কোনোটাতেই চান্স হয়নি শুভর। এত ভালো পড়ালেখা করা সত্ত্বেও চান্স না পাওয়ায় সে অত্যন্ত হতাশ। এমনকি এ প্লাস না পাওয়ায় কয়েকটি ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দেবারই সুযোগ পায়নি সে। এটি নিয়ে তার বাবা মা এখনো তার এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে তাকে কথা শোনায়। পরিবার থেকে অনেকটাই আইসোলেটেড হয়ে গেছে শুভ। ফ্রেন্ড সার্কেলে অনেকেই ভালো ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় ওদের সাথেও মেলামেশা কমে গেছে তার। বলা যায় সমাজ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন সে। প্রায়ই তার মনে হয় এত গঞ্জনা সহ্য করার চাইতে এই ব্যর্থ জীবনকে শেষ করে দেয়াই শ্রেয়। বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুভ। তার ভাবনা, এ জীবন রেখে আর কি হবে? মরে গেলেই হয়ত বেঁচে যাবে সে।

শুভর মধ্যে যে ভাবনাটি গড়ে উঠছে তাকে সুইসাইডাল থট কিংবা সুইসাইড আইডিয়েশন নামে অভিহিত করা হয়। আত্মহত্যার চিন্তা করা কিংবা প্ল্যান করাই হচ্ছে সুইসাইডাল আইডেয়শন। ব্যাক্তির মধ্যে এই চিন্তাটি অনেকদিনের গোছানো কিংবা হুট করে আসা দুই ভাবেই হতে পারে। সুইসাইডাল থট অত্যন্ত সাধারণ একটি বিষয়। প্রত্যেকেই জীবনের কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে সুইসাইডাল থট এর শিকার হন। কোনো বিষয় নিয়ে এ্যাংজাইটি কিংবা ডিপ্রেশন থেকে মানুষ সুইসাইড নিয়ে চিন্তা করে। সাধারণত সুইসাইডাল থট একটি অস্থায়ী বিষয় হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি বিপদজনক এবং ব্যক্তিকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়। প্রথমত একজন ব্যক্তি নিজেকে ব্যর্থ, অকেজো ইত্যাদি ভাবা শুরু করে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া, বেকারত্ব ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক চাপ এবং অবজ্ঞার মুখে এবং তার মনে হয় হয়ত জীবন শেষ করে দিলেই এইসব থেকে মুক্তি মিলবে। এক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় সে কাউকে অনুকরণ করতে চাইছে। সেটি হতে পারে তার পরিবারের কেউ যে কিনা আত্মহত্যা করেছে কিংবা কোনো সেলিব্রেটি। “মরে গিয়ে তো বেঁচে গেছে সে” এই ধরণের চিন্তা লালন করে সে। তার মধ্যে এই ধারণা  আসতে থাকে যে কেউ তাকে বুঝতে চাইছেনা কিংবা কেউ তাকে গ্রাহ্য করছেনা। এইজন্য অনেক ক্ষেত্রে “এ্যাটেনশন সীকিং”কেও ব্যক্তির সুইসাইডাল থট আসার কারণ হিসেবে ধরা যায়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেকে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। সে মনে করে তার জন্যই সকল সমস্যার শুরু, অতএব মরে যাওয়াই শ্রেয়। আমরা আশেপাশে অনেকেই রয়েছে যে কিনা হয়ত প্রতিদিনই অল্প অল্প করে আত্মহননের উপায় নিয়ে চিন্তা করছে, উপকরণ নিয়ে ভাবছে। আমরা হয়ত গ্রাহ্য করছিনা কিংবা বুঝতে পারছিনা। একসময় হয়ত শুনতে পাবো সে সুইসাইড করতে সফল ও হয়েছে।
সুইসাইড নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বর্তমান বিশ্বের ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে সুইসাইড বা আত্মহত্যা একটি বড় সমস্যা। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় দিনকে দিন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই আত্মহত্যা। বর্তমানে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ সুইসাইড করে। সমগ্র পৃথিবীতে যুবক যুবতীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এই সুইসাইড। যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই তবে গত ১ বছরে ১৭ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে। এবং প্রতি বছর এই হার বেড়েই চলেছে। একটা মানুষ যখন তার নিজের জীবনের প্রতি সমস্ত আকর্ষণ কিংবা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে তখনই সে সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় তার সবথেকে বেশি প্রয়োজন কাছের মানুষদের সংস্পর্শে থাকা।  
প্রতিরোধঃ
এই সুইসাইডাল থট কিংবা সুইসাইড আইডিয়েশন একটি ক্ষণস্থায়ী বিষয় হলেও এটিকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। একজন মানুষ যখন সুইসাইড নিয়ে চিন্তা করে তখন তার কথাবার্তা আচার ব্যবহারে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন সে হয়ত তার প্রিয় কোনো বস্তু যা কিনা সবসময় নিজের কাছে আগলে রাখতো সেটিকে ফেলে দিচ্ছে কিংবা কাউকে দিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে অন্যদের বোঝা হিসেবে দেখছে। তার কথাবার্তার মধ্যেও নিরাশার ছাপ পাওয়া যায়। “বেঁচে থেকে কি হবে?” “আমি মরে গেলেই হয়ত সবার জন্য ভালো” ইত্যাদি কথাও বলতে শোনা যায়। ব্যক্তি মৃত্যুকে নিয়ে কথা বলে। পরিবার কিংবা বন্ধু বান্ধব থেকে নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিচ্ছে। এইসমস্ত লক্ষণ দেখা দিলে আমরা ধরে নিতে পারি ব্যক্তির মধ্যে সুইসাইডাল থট বিরাজ করছে। এই সুইসাইডাল থট প্রতিরোধে পরিবার এবং বন্ধুরা বড় ধরণের সাহায্যে এসে থাকেন। কথা বলে, সময় দিয়ে সুইসাইডাল থট থেকে ব্যক্তিকে সরিয়ে আনতে পারেন তারা। ব্যক্তিকে নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করা, তাকে সাহস দেয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবার এবং বন্ধু বান্ধবের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। অনেক সময় প্রফেশনাল হেল্প ও প্রয়োজনীয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা কিনা সুইসাইডাল থট প্রতিরোধে কাজ করছে। এছাড়া সাইকোলজিস্ট এবং কাউন্সেলররাও প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মূলত কথা বলা এবং শেয়ারিং এর মাধ্যমেই ব্যক্তিকে সুইসাইডাল থট থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে আনা হয়। এছাড়া ব্যক্তি বিভিন্ন থেরাপির সাহায্য ও নিতে পারেন সুইসাইড কোনো সমাধান নয়। আপনার সুইসাইডাল থট আসছে এর মানে এই নয় যে আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। আপনার আশে পাশের অনেক মানুষেরই সুইসাইডাল থট আসে এবং অনেকেই এটি থেকে মুক্তি পায়। এখানে সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে কথা বলা। নিজের ভাবনাকে নিজের মধ্যে পুষে না রেখে অন্যের সাথে শেয়ার করা, নিজের উপর বিশ্বাস রাখা। কথা বলুন, সুইসাইডাল থটকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আপনি ঠুনকো কিছু নন, একটি ব্যর্থতা আপনার গল্পকে শেষ করে দিচ্ছেনা। হয়ত সবেমাত্র তা শুরু। নিজেকে বলুন “My story will not end up in this way.”

আশিক মাহমুদ।

Loved this article? Share with your community and friends.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share