হাসান অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। ছোটবেলা থেকেই একটূ লাজুক প্রকৃতির ছেলে। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানেও তেমন অংশ গ্রহণ করেনা। বন্ধুদের আড্ডায়ও চুপচাপ। আসলে কথা বলতে ভয় পায়- যদি বন্ধুরা ঠাট্টা করে বসে! ক্লাসরুমে টিচার পড়ানোর সময় কোনোকিছু বুঝতে না পারলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে ভয় পায়। ভাবে, যদি তার ক্লাসমেটরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে! অথবা যদি নার্ভাস অবস্থায় প্রশ্ন করেও বসে তখন প্রশ্ন করতে যেয়ে কথা আটকে যাওয়া কিংবা তোতলানোর ফলে শিক্ষক যদি তাকে তাচ্ছিল্য করেন! ধুর! থাক না, কী দরকার! যার ফলে আর প্রশ্ন করা হয়না। ক্লাস শেষে অনেক বিষয় নিয়েই কনফিউশন থেকে যায় হাসানের।
মৌমিতা বেশ ভালো গান গায়। আজ প্রথমবারের মত সে কলেজ ফাংশনে গান গাইবে। একটু পরেই স্টেজে তার নাম ঘোষণা হবে। কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছে। যদি গানের লিরিকস বা টোন ভুল হয়ে যায়!! কী একটা লজ্জাজনক বিষয়! স্টেজে ওঠার পর হলভর্তি মানুষ দেখে ভয়টা যেন আরো জাঁকিয়ে বসলো মৌমিতার। স্টেজে উঠে ভুল গান গাওয়া! ছিঃ ছিঃ লোকে কি বলবে! হাত পা কাঁপছে মৌমিতার, গলা শুকিয়ে আসছে, হাত থেকে মাইকটা পড়েই গেলো।
এই মৌমিতা বা হাসানের মত অনেকেই আছে যারা কিনা এইরকম জনসম্মুখে কথা বলতে কিংবা যেকোনো কাজ করতে ভয় পান কিংবা অস্বস্তি অনুভব করেন। নিজেদের মতামত কিংবা পারফর্মেন্স সম্পর্কে অহেতুক দুশ্চিন্তা করেন। যদি ভুল হয় তো মানুষ কি বলবে!!! এই টেনশন কাজ করতে থাকে নিজের ভিতর। মনোবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে আগে “সোশ্যাল ফোবিয়া” বলে উল্লেখ করলেও এখন এটিকে “সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার” নামেই অভিহিত করে থাকেন। যাদের এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার রয়েছে, তারা সামাজিক সিচুয়েশনগুলোতে নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। তারা মানুষ কি ভাববে এই নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। আমরা যদি সোশ্যাল এ্যাংজাইটির উদাহরণ নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে প্রধানত এই পাবলিক প্লেসে কথা বলা কিংবা খাওয়াদাওয়া করার কথা আসবে। স্টেজ পারফরমেন্স এর বেলায় ব্যক্তির মধ্যে এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কাজ করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। ২০০৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া অস্ট্রিয়ান লেখিকা এলফ্রিদে ইয়েলিনেক স্টকহোমের আড়ম্বরপূর্ণ নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানে আসেননি। তার সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার ছিলো বিধায় তিনি তার নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করেন একটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এতে আমরা হয়তো বুঝতে পারছি এই ডিসঅর্ডারটি যেকোনো মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে। কিন্তু এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি আমাদের কেন হয়ে থাকে?
গবেষকরা বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটির কারণ হিসেবে। তারা বলেন, এমন অনেকে আছেন যারা নিজেদের সম্পর্কে কিছু ধারণা নিজের মধ্যে লালন করেন, যেমন তারা হয়ত দেখতে আকর্ষণীয় নন কিংবা তারা যেকোনো কাজে দক্ষতার পরিচয় রাখতে পারবেন না অথবা দক্ষতার সাথে কোনো কাজ করতে গেলে তারা ব্যর্থ হবেন এবং মানুষ তাকে তার ব্যর্থতার জন্য ব্যঙ্গ করবে। তারা মনে করেন যে সামাজিক কোনো সিচুয়েশনে তার ব্যবহারের ফলে মানুষ তাকে তিরস্কার করবে। এই ধরণের নানারকম চিন্তা ভাবনা ব্যক্তির ভিতর গেঁথে যাওয়ার ফলেই মূলত এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটির সূচনা হয়।
সোশ্যাল এ্যাংজাইটি আমাদের বিশ্বে বেশ সাধারণ একটি বিষয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় আমেরিকায় প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭ জনের এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি রয়েছে। পুরুষদের চাইতে মহিলাদের এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগার হার বেশি। প্রতি ২ জন পুরুষের অনুপাতে ৩ জন মহিলা এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটির মধ্য দিয়ে যায় (ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, জানুয়ারী, ২০১৮) বাংলাদেশে এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা মানুষের হার শতকরা ৪ ভাগ। (ডেইলি স্টার, জুন, ২০১৮)
সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা মানুষজনের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলোর ভেতর কথা বলায় জড়তা অনুভব করা, নার্ভাস ফীল করা, ঘাম হওয়া, কাঁপুনি অনুভব করা কমন। অনেক সময় বেশি সংখ্যক মানুষের সামনে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা কিংবা নাচ-গান পারফর্মের সময় দুশ্চিন্তা অনুভব হওয়া কিংবা ভয় পাওয়া বিষয়টিকে “স্টেজ ফ্রাইট” (Stage Fright) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই স্টেজ ফ্রাইটের কারণ হচ্ছে সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার। ব্যক্তি মনে করেন যে তিনি দক্ষতার সাথে পারফর্ম করতে পারবেন না এবং দর্শকরা তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে; একজন স্টুডেন্ট মনে করে করে যে সে হয়তো ভালোভাবে তার এ্যাসাইনমেন্টটি রুমভর্তি অন্যান্য স্টুডেন্টদের সামনে প্রেজেন্ট করতে পারবে না। ফলে সে ভীত হয়ে পড়ে।
তবে সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কোনো দুরারোগ্য বিষয় নয়। গবেষকরা এর প্রতিকার বের করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা একে “এক্সপোজার থেরাপী” নামে উল্লেখ করে থাকেন যা কিনা বিভিন্ন ধরণের ফোবিয়া ট্রিটমেন্টের সময় ব্যবহার হয়ে থাকে। থেরাপিস্টরা বলেন সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা ব্যক্তিকে বেশি বেশি সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার এই অহেতুক ভয়টি তিনি কাটিয়ে উঠছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সাধারণ ভাবে হাসান কিংবা মৌমিতার মত সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা মানুষদের অন্যান্য পরামর্শ দেয়া হয়। যেমন ছোট গ্রুপে কথা বলা। যেহেতু তারা পরিচিত ও খুব কম মানুষের সামনে কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেহেতু প্রথমে তাদেরকে তাদের বন্ধুদের সামনেই কথা বলতে বলা হয়। এরপর হয়তো তাদের সেই গ্রুপে এক দুইজন অপরিচিত ব্যক্তিকে আনা হয়। এরপর আস্তে আস্তে সেই সংখ্যাটি বাড়ানো হয়। একে বলে গ্রুপ থেরাপি। এভাবে আস্তে আস্তে মানুষের সামনে কথা বলতে পারা ব্যাপারটা তাকে যেকোনো সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে এ্যাংজাইটি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। গ্রুপ থেরাপিতে গ্রুপ মেম্বাররা ব্যক্তিকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার প্রশংসা করেন যাতে ব্যক্তি কথা বলতে কিংবা গান গাইতে সাহস পান। মৌমিতার মত স্টেজ ফিয়ারযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য অনেক সময় থেরাপিস্টরা আয়নার মত খুব সাধারণ একটি বিষয় ব্যবহার করেন। ব্যক্তিকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজেকে দেখে পারফরম করতে বা কথা বলতে বলা হয়। এরপর হয়তো দুই একজন মানুষের সামনে তাকে উপস্থাপন করা হয় কথা বলার জন্য। এভাবে আস্তে আস্তে সে এ্যাংজাইটি কাটিয়ে ওঠা এবং কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা ছাড়াই কথা বলা কিংবা যেকোনো কাজ করতে পারার কৌশল রপ্ত করে। আমরা বলছি না আপনি দুই-একবারের চেষ্টাতেই মোটিভেশনাল স্পীকারদের মত স্টেজ কাঁপিয়ে দিতে পারবেন। তবে এ্যাংজাইটি কাটিয়ে নিজেকে ভালোভাবে প্রেজেন্ট করতে পারাটাই এখানে বড় সাফল্য। এক্ষেত্রে সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কাটাতে ব্যক্তির চেষ্টা এবং ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে বড় উপায়। মূলত বারবার প্র্যাকটিসের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কেটে উঠতে পারে বলে মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা।
(আশিক মাহমুদ)