কোন ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিত, জোরপূর্বক তার সাথে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়াই ধর্ষণ। ধর্ষণের পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণ খুজতে গেলে, প্রথমেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানর মতো আসে যৌন অবদমন এর কথা। অর্থাৎ, ধর্ষণের ব্যাপারে সহজ থিওরি হলো ধর্ষক বিভিন্ন সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কারনে তার কাম-বাসনা মেটাতে পারে না, ফলে তার মাঝে অপরিতৃপ্ত যৌনাকাঙ্ক্ষা পুঞ্জিভূত হতে হতে একসময় কোন অসতর্ক নারীর উপস্থিতিতে ধর্ষণের মতো ভয়ানক অপরাধ রুপে বের হএ আসে। ধর্ষণের এই তত্ত্ব যতটা সহজ ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর, কেননা এই তত্ত্ব ভিকটিম শেমিং এর সুযোগ তৈরি করে দেয়। ব্যাপারটা এমন যেন নারী যদি সঠিক পোশাক না পরে, সঠিক আচরন না করে তবে তা একজন ধর্ষকে প্রলুব্ধ করে, এবং ধর্ষণ করার সময়ে ধর্ষকের দোষ থাকে না কারণ তার যৌনতা অবদমিত! ধর্ষণ না করে তার যেন উপায়ই ছিল না। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত “তেঁতুল ঝুলালে লোল পরবেই” বা “খোলা মিষ্টিতে মাছি বসবেই” এমন কথাবার্তার যথার্ততা দেয় এই তত্ত্ব।
ধর্ষণের এই ধারনা বহু প্রাচীন। এমনকি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফ্রয়েডিও ঘরানার মনোবিজ্ঞানীদের কাছেও এটি জনপ্রিয় ছিল। তারা কেবলমাত্রও এটাই ভাবেন নি যে ধর্ষিতারাই ধর্ষণে প্রলুব্ধ করে, তারা আর বলেন সকল নারী অবচেতন ভাবে ধর্ষিত হতে চান!
তবে এই ধারনায় বড় রকমের আঘাত আসে নারীবাদী সুজান ব্রাউনমিলারের বই “এগেন্সট আওয়ার উইল” (১৯৭৫) প্রকাশিত হবার পর। এই বইতে তিনি বলেন ধর্ষণ হল একটি সচেতন প্রচেষ্টা যার মাধ্যমে সকল পুরুষ সকল নারীকে একটি আতঙ্কিত অবস্থার মাঝে রাখে। ব্রাউনমিলার এই ধারনা কে চ্যালেঞ্জ করেন যে ধর্ষণ হল অবদমিত যৌন আকাঙ্খার ফসল, পরিবর্তে তিনি বলেন ধর্ষণ লিঙ্গ রাজনীতির ফসল।ধর্ষণের পেছনের প্রেষণা যৌনতা নয়, ক্ষমতার বিস্তার। নারীর ওপর পুরুষের ক্ষমতার বিস্তার। এবং বর্ণবাদের মতই লিঙ্গবাদকে প্রতিরোধ করতে পারলে,ধর্ষণের প্রতিকার আসবে।
ধর্ষণে যদি কেবলমাত্র যৌন আকাঙ্খাই দায়ী থাকে, তবে তো শুধু নারীরাই ধর্ষণের শিকার হতেন। কিন্তু বাস্তবে তো দেখা যাচ্ছে নারীদের পাশাপাশি শিশু এবং বয়স্ক নারীরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, যাকে কোনভাবেই যৌন আকাঙ্খা দিয়ে ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়।
পরবর্তীতে বেশ কিছু গবেষণায় ধর্ষণের নারীবাদী ধারনার সত্যতা পাওয়া যায়।তার মাঝে সর্বপ্রথম ও সবচে প্রভাবশালী গবেষণা করেন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস গ্রথ। ১৯৭৯ সালে তার প্রকাশিত “মেন হু রেইপ” এ তিনি দেখান যে সকল ধর্ষকের তিনটি মোটিভ থাকতে পারে, ধর্ষকাম( স্যাডিজম), ক্রোধ এবং খমতা।তিনি বলেন ধর্ষণ কোনভাবে সুস্থ মস্তিস্কের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কোন স্থায়ী অথবা সাময়িক মনবিকারগ্রস্থ মানুষের পক্ষেই সম্ভব।তিনি আরও দেখান যে ধর্ষণ একটি যৌনক্রিয়ার আড়ালে ক্ষমতা এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। তার গবেষণায় কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা থাকলেও ধর্ষণ নিয়ে তার গবেষণাকেই প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাজ বলে গণ্য করা হয় যেটি ধর্ষণকে যৌনতার বাইরের মোটিভ দিইয়ে দেখাতে চেয়েছেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ধর্ষকদের শরীরে টেস্টোস্টেরন এর মাত্রা সাধারনের থেকে বেশি নয়। এছাড়া যৌনসহবাস এর অভাবের সাথেও ধর্ষণের কোন সংগতি পাওয়া যায় নি। যেমন পল গেবহা্রড ও তার সহকর্মীরা তাদের “সেক্স অফেন্ডার্সঃ এন এনালাইসিস অব টাইপস” (১৯৬৫) প্রকাশনায় দেখিয়েছেন বিবাহিত ধর্ষকরা তাদের স্ত্রীর সাথে সহবাসে সক্রিয় থাকেন। এই সমস্ত গবেষণা এটাই নিরদেশ করে যে কেবল যৌন অবদমনে পুঞ্জীভূত কামবাসনাই ধর্ষণের মূল কারণ নয়।
তবে কি ধর্ষণের মূল কারণ পাওয়া গেল যৌনতা নয় ক্ষমতাই এর পেছনে দায়ী? আসলে যেকোনো আচরণকে একটিমাত্র মাত্রা দিএ ব্যখ্যা করা কঠিন। পাশাপাশি ক্ষুধা তৃষ্ণার মতো যৌনতা একটি সহজাত প্রবৃতি ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় রিচার্ড ফেলসন ও তার কলিগ প্যট্রিক কানডিফ, এফ বি আই থেকে নেয়া ৩০০০০০ ধর্ষণের নথি পর্যালোচনা করে দেখেন যে একজন ধর্ষিতার বয়স গড়ে ১৫ বছর। এর আগেও রিচার্ড ফেলসন ও রিচার্ড মোরান পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখান যে অধিকাংশ ধর্ষিতাই তরুণী। সায়েন্টিফিক লিটারেচারে তারুন্য , যৌন আকর্ষণের সাথে সম্পর্কিত। এটা বলা যেতে পারে যে ধর্ষকরা তরুণীদের আক্রমন করছে কারণ তাদের টার্গেট করা সহজ। তবে বয়স্কা নারী এবং শিশুরাও তুলনামূলক সহজ টার্গেট, কিন্তু পরিসংখ্যান হিসেবে তাদের আক্রান্ত হবার হার তরুণীদের তুলনায় কম। বলা যায় ধর্ষণের মূল ভিক্টিম হচ্ছে তরুণরা কেননা তারা যৌন আবেদনময়ী এবং ধর্ষণের পেছনে রয়েছে ধর্ষকদের যৌনমিলনের ইচ্ছা।
এছাড়া কিছু ল্যাবরেটরি গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে ধর্ষকদের যৌন উত্তেজনার প্যাটার্ন ভিন্ন রকম। তারা অস্মমতিতে করা যৌনক্রিয়ার কথা শুনলে তাদের তীব্র লৈঙ্গিক প্রতিক্রিয়া হয়।এবং ২০১২ সালে কানাডীয় গবেষক গ্রান্ট হ্যারিস ও তার সহকর্মীরা গবেষণায় পান যে যৌনক্রিয়া বিহীন আগ্রাসন ও জখমের ক্ষেত্রে ধর্ষকদের লৈঙ্গিক প্রতিক্রিয়া খুব একটা হয় না।
অর্থাৎ, সম্মতি বিহীন যৌনক্রিয়ায় ধর্ষকরা যে আনন্দ পায়, যৌনক্রিয়া বিহীন আগ্রাসনে সেরকম আনন্দ তার পায় না। সুতরাং পূর্বের ও পরের গবেষণার আলোকে বলা যায় ধর্ষণকে একইসাথে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং যৌনাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থের উপায় হিসেবে ধর্ষকরা বেছে নেয়। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেভারলি ম্যাকফিল ধর্ষণের মোটিভের ওপর বিভিন্ন নারীবাদী তত্ত্ব একত্রিত করে ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের একটি মডেল দাড়া করান। তিনি বলেন ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক ও আগ্রাসী আচরন যার মাধ্যমে পুরুষেরা দলবদ্ধভাবে নারীদের ওপর আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং ের পেছনের মোটিভ একটি নয় বরং অনেকগুলো, যেমন যৌনপরিতৃপ্তি ,প্রতিশোধ, মনোরঞ্জন, ক্ষমতা/আধিপত্য এবং পৌরুষ্য প্রদর্শনের মনোভাব।
সুত্রঃ
Rape is Not (Only) About Power; It’s (Also) About Sex
লেখকঃ মিশাদ