পাগলামির ইতিহাস

Share

আদিম যুগ

 আদিম যুগে মানুষ শারীরিক ব্যাধি আর মানসিক ব্যাধির মধ্যে কোন পার্থক্য জানত না।তখন মনে করা হতো এক অশরীরী শক্তি মানুষ, প্রানী, এবং বস্তুগুলোর মধ্যে থেকে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রন করে।তখন শারীরিক ও মানসিক রোগগুলোকেও ঐসব অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কাজ বলে মনে করা হত।

অতিপ্রাকৃতিক শক্তি দু রকম ছিলঃ ভাল এবং মন্দ (অনেকটা ফেরেশতা ও শয়তানের মত)।ভাল শক্তি কে বলা হত ঈশ্বরের দান হিসেবে আর মন্দ শক্তিকে বলা হত  ‘দানব’ ( প্রেত/ভূত)।মানুষ যখন খারাপ কাজ করত তখন ঈশ্বর তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভূতকে পাঠাতেন অভিশাপ হিসেবে।এসব বিশ্বাস কে বলা হত প্রেততত্ত্ব।প্রস্তর যুগে মানুষের রোগ ব্যাধি সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্বাস প্রচলিত ছিল বিভিন্ন দেশে যেমন-হিব্রুদের মধ্যে, মিশরীয়দের মধ্যে, প্রাচীন গ্রীসে এবং চীন দেশে।

ক্রমশঃ প্রেততত্ত্ব শারীরিক ব্যাধির চেয়ে মানসিক ব্যাধির সঙ্গে বেশি অনুষঙ্গবদ্ধ হয়ে পড়ে ।অর্থাৎ লোকেরা ভূত- প্রেতকে মানসিক ব্যাধির জন্য বেশি দায়ী করে।কিন্ত শারীরিক ব্যাধির জন্য ভূত- প্রেতকে এতটা দায়ী করতো না।যে শারীরিক ব্যাধিতে ভুগছে সে কষ্ট পাচ্ছে,কিন্ত তার চেতনা বা মস্তিষ্ক ঠিক আছে বলে সে চিকিৎসকের কাছে সাহায্য চাইতে পারে।যদিও অনেক আদিম সমাজে শারীরিকভাবে ব্যাধিগ্রস্তদের ও ভয়ের চোখ দেখা হত।কারন শারীরিক ব্যাধি অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং সমস্ত গোষ্টীকে দুর্বল করে ফেলতে পারে।অবশ্য শারীরিক ব্যাধিগ্রস্তের প্রতি দয়া বা অনুকম্পা হত এবং গাছ –গাছড়া থেকে প্রস্তুত ঔষধের মাধ্যমে তাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা হত।কিন্তু যেহেতু মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যাক্তি নিজের অসুখ বুঝতে পারে না, সেজন্য সে সাহায্য চায় না অথচ অদ্ভুত আচরন করে।সেজন্য আদিম সমাজের মানুষ মানসিক রোগীদের ভয় পেত এবং ভয়ের ফলে মানসিক রোগ সম্পর্কে তাদের মনে নানা রকম অলীক বা আজগুবি ধারনা সৃষ্টি হয়েছিল।সে মনে করত কেবল মাত্র একটি অসাধারন সত্তা-যেমন ভূত-প্রেতই একটি অদ্ভুত আচরন সৃষ্টি করতে পারে। প্রেত তত্ত্বে দুটি উপাদানের সংমিশ্রনে ঘটেছে – একটি হল অতিপ্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাস এবং অন্যটি হল ম্যাজিক বা ডাকিনীবিদ্যার ধারনাটি ছিল এই যে, যারা প্রেত দ্বারা অধিকৃত বা আশ্রিত সত্তা ( যেমন ভূত- প্রেত এর সাহায্য কাজ করে এবং এগুলো প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে নিয়মমত ঘটতে বাধা দেয়)আর ডাকিনীবিদ্যার  (যাদুবিদ্যার) ধারনাটি ছিল এই যে, যারা প্রেত দ্বারা অধিকৃত বা আশ্রিত হয় তারা প্রেতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের অনিষ্ট করতে পারে।এদের বলা হত যাদুকর বা ডাইনি।অনেকেই মনে করতো যে, প্রেতাত্মারা অসুস্থ ব্যাক্তির সঙ্গে যোগসাজস করে ডাইনিকে যাদু শক্তিকে দিতে পারে।

প্রস্তর যুগের প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন, বাইবেল ও অন্যান্য পুস্তকাদি থেকে প্রামান পাওয়া যায় যে, সেই যুগে মানসিক ব্যাধির জন্য প্রেতের আশ্রয় করাকে দায়ী করা হতো।প্রস্তর যুগের মানুষের মাথার খুলি থেকে এ ধরনের প্রমান পাওয়া গেছে।কিছু কিছু মাথার খুলিতে একটি গোলাকৃতি ছিদ্র পাওয়া গেছে।এতে মনে হয় যে, মানুষের  মাথার খুলিতে ছিদ্র করা হতো।তখনকার বিশ্বাস ছিল যে, প্রেতগ্রস্ত মানুষের মাথায় যে প্রেতাত্মা প্রবেশ করেছে সেটি ঐ ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যাবে।এ ধরনের অপারেশনের পর কিছু রোগী বেঁচে যেত-যার প্রমান পাওয়া যায় ছিদ্রের ধারের হাড়গুলো মোটা হয়ে যাওয়ার ফলে।অনেক রোগী হয়ত ভাল হয়ে যেত।বিশেষ করে যাদের মাথার খুলিতে বেশি চাপ থাকতকিন্তু এটা হয়ে থাকলে বুঝতে হবে যে এক উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করে অন্যধরনের ফল পাওয়া।এধরনের ঘটনা চিকিৎসা শাস্ত্রে আরো অনেকবার ঘটতে দেখা গেছে।

যেমন, বিংশ শতাব্দীতে বৈদ্যুতিক আঘাতের দ্বারা অনেক মানসিক রোগীর চিকিৎসা করে ভাল ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু  যারা এটির আবিষ্কার করেছিলেন তারা এর কার্যকারিতা সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা দিতেন তা গ্রহনযোগ্য নয়।ঠিক তেমনিভাবে –মনোচিকিৎসা বা সাইকোথেরাপির কার্যকারিতা চিকিৎসা পদ্ধতির চেয়ে বরং মনোবিজ্ঞানীর ব্যক্তিত্বের উপরে বেশি নির্ভর করে।

বাইবেলের অনেক উক্তি অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস রচয়িতাদের আগ্রহ সৃষ্টি করে । বাইবেলে মানসিক রোগের জন্য অতিপ্রাকৃতিক কারণকে দায়ী করা হয়েছে। যেমন “ ঈশ্বর তোমাকে উন্মাদ করে, অন্ধ করে এবং হ্রদস্পন্দন বন্ধ করে তোমাকে  সজোরে হঠাৎ আঘাত করবেন”

খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীর সাহিত্যে দেখা যায় ঈশ্বর এক প্রেতাত্মাকে পাঠীয়ে আত্মা কে তার অবাধ্যতার জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন। আত্মা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, বস্ত্র পরিত্যাগ করেছিলেন এবং তার ছেলেকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।‘ পাগলামির ভান করে ডেভিড তার শত্রুদের থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন কারন তারা মনে করেছিল যে তার লক্ষণগুলো ঈশ্বরের কৃপায় হয়েছে এবং সেজন্য তাকে সম্মান করা উচিত।এমন কি গ্রীক সভ্যতার যুগেও মৃগী রোগকে পবিত্র রোগ বলে মনে করা হত। এ রোগের লক্ষনকে মনে করা হতো দেবতা কর্তৃক সম্মানের চিহ্ন হিসেবে। ব্যবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার এর ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে তিনি একটি বন্যগরু এবং তিনি ঘাস খেতেন। কথিত আছে যে যীশু খ্রিস্ট যাদু মন্ত্রের সাহায্যে একজন ব্যক্তির শরীর থেকে শয়তানদের তাড়িয়ে ছিলেন।সাধারনভাবে বলতে গেলে মানসিক ব্যাধির  জন্য যে ধরনের প্রেতাত্মাকে দায়ী করা হত, তার চিকিৎসা ও ঠিক করা হতো সেই অনুসারে। যদি প্রেতাত্মা কে ভাল বলে মনে করা হতো তাহলে আশ্রিতকে সম্মান করা হতো, আবার যদি প্রেতাত্মা শয়তান হতো বা খারাপ হতো, তাহলে হয়তো দেবতাদের স্তব করা হতো প্রেতাত্মাকে সরিয়ে নেয়ার জন্য, অথবা ঝাড়- ফুঁক হতো,আবার কঠোর শাস্তি দিয়ে শয়তান তাড়ানো হতো।আদিম যুগ শেষ হওয়ার শত শত বছর পরেও মধ্যযুগ পর্যন্ত এসব বিশ্বাস টিকে ছিল।মধ্যযুগে কঠোর শাস্তির সঙ্গে কিছু মৃদু ব্যবস্থা ও প্রচলিত ছিল।আশ্রিত বা ভূতে পাওয়া ব্যক্তিকে কিছু পবিত্র বস্তু স্পর্শ করতে দেয়া হতো,তাদের কানের কাছে তীব্র শব্দে বাদ্য বাজানো হতো, নাকে দুর্গন্ধ প্রবেশ করানো হতো (যেমন লঙ্কা পুড়িয়ে ঝাঁজ দেয়া)এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন ওঝা /পুরোহিত শয়তানের চিত্তের উপর লাঠি বা ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করতেন।তারা বিশ্বাস

করতেন যে, এভাবে ভয় দেখানো হলে প্রেতাত্মা রোগীর দেহ ছেড়ে পালাবে।এতে কাজ না হলে শুরু হতো কঠীন শাস্তি।যেমন চাবুক মারা, উপবাস করতে বাধ্য করা, অত্যাচার করা-এমন কি হত্যা করা হতো।যে কোনভাবেই হোক ভূত- প্রেতকে তাড়াতেই হবে।এটা একদিকে যেমন ছিল শাস্তি, আবার অন্যদিকে ছিল করুণা –কারন এর মাধ্যমে ব্যক্তিকে প্রেতাত্মার অধিষ্টান থেকে মুক্ত করা হতো।এই যুক্তিতেই মধ্যযুগে ডাইনিদের পুড়িয়ে মারা হতো

গ্রীক ও রোমান অভিজ্ঞতাবাদের উত্থান

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে ২০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ৬০০ বছরের মধ্যে বিজ্ঞানে প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এর ফলে মানসিক রোগীদের পর্যবেক্ষণ, তাদের লক্ষনগুলোর অর্থবোধ করা এবং চিকিৎসায় প্রচুর উন্নতি হয়।প্রথমে গ্রীসে ও পরে রোমের জনসাধারণ পূর্বেকার কুসংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকেন। কিন্তু তারা সম্পূর্ণ ভাবে সফল হতে পারেন নি।কারন তারা নিজেদের পক্ষপাত দোষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি।কিন্তু তা সত্ত্বেও, তারা যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। সেই যুগটা শুরু হয় হিপোক্রেটিস (৪৬০-৩৭৭ BC) এর অবদানের মধ্য দিয়ে। হিপোক্রেটিসকে চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক বলা হয়। তিনিই সর্ব প্রথম মনো বিকৃতির গবেষনা ও ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞতা ভিত্তিক এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রচলন করেন। মানসিক রোগ সম্পর্কে অতিপ্রাকৃত ব্যাখার মূলে তিনি আমূল পরিবর্তন করেছিলেন।মৃগী সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় এ রোগটি অন্যান্য শারীরিক রোগের চেয়ে বেশি বা কম পবিত্র ও স্বর্গীয় নয়।কিন্তু প্রত্যেকটি রোগের প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে-যা থেকে রোগটি সৃষ্টি হয়। আপনি যদি এসব রোগীর মাথার খুলি কেটে ভিতরে দৃষ্টিপাত করেন, তাহলে দেখবেন, মস্তিষ্কটি আর্দ্র, ঘামে বোঝাই এবং এর থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে।এ থেকে আপনি বুঝতে পারবেন যে, শরীরে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় বা শরীরকে যে কষ্ট দেয় সে কোন একটি দেবতা নয়,বরং একটা রোগ।

হিপোক্রেটিস এর ব্যাধির কার্যকারণ সম্পর্কিত তত্ত্ব ছিল সহজ। তিনি মনে করতেন, মানসিক ব্যাধি শুধুমাত্র মস্তিষ্কের রোগ বা ক্ষয়ক্ষতি, মস্তিষ্কে আঘাত, অথবা হিউমার বা পিত্ত রসের আধিক্যের জন্য সৃষ্টি হয়। এই তত্ত্বই ব্যক্তিত্বকে কতকগুলো টাইপ বা শ্রেনীতে ভাগ করা হয়।এই তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তিত্বের বিকৃতি এবং আবেগের গোলযোগ হল স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিমাণগত অধিক্য। হিপোক্রেটিস মানসিক ব্যাধির যে শ্রেনী বিন্যাস করেছিলেন তাহলোঃ মৃগীরোগ, ম্যানিয়া বা উত্তেজনা, মেলাঙ্কেলিয়া বা বিষন্নতা এবং মানসিক অবনতি ।এটা ছিল সুচনা।তারপর থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক আচরণকে একটি  সমন্বিত বা সামগ্রিক পদ্ধতির মধ্যে এনে শেনিবিভাগ করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। মনোচিকিৎসা শাস্ত্রে হিপোক্রেটিস এর অবদানগুলো এই রকমঃ

১।তিনি সর্ব প্রথম মানসিক ব্যাধির প্রাকৃতিক এবং জৈবিক কারনের কথা বলেন।

২।তিনি শারীরিক গঠনের সঙ্গে মেজাজ ও ব্যাক্তিত্বের  সম্পর্ক দেখান।

৩।তিনি কতকগুলো মানসিক রোগের (যেমন- মৃগীরোগ,বিষন্নতা রোগ, উদ্বেগ )উৎপত্তি, বিকাশ ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন।

৪।তিনি মানসিক রোগের প্রথম শ্রেনীবিভাগ করেন

৫।তিনি মনে করতেন যে, হিস্টিরিয়া – যা একটি নিউরোসিস জাতীয় ব্যাধি হিসাবে ইতিপূর্বে ছিল, প্রকৃত পক্ষে জরায়ুর স্থান পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট একটি শারীরিক ব্যাধি। এবং এটা শুধু স্ত্রী লোকদের মধ্যে দেখা দেয়।এই ধারনাটি প্রায় ২০০০ বছর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

৬।তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য রক্তমোক্ষন পদ্ধতি উপকারী নয়।তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন যে, শারীরিক ব্যাধি সৃষ্টি হলে মানসিক ব্যাধি সাময়িকভাবে উপশম হয়।

৭। হিপোক্রেটিস এর আরেকটি অবদান ফ্রয়েডের স্বপ্ন তত্ত্ব কে আঁচ করতে পেরেছিল। হিপোক্রেটিস বলেছিলেন যে, স্বপ্ন হলো জাগ্রত অবস্থার বাস্তবতার নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন।

হিপোক্রেটিস এর মৃত্যুর পর বৈজ্ঞানিক চিন্তার মৃত্যু ঘটে এবং অস্বাভাবিক আচরন সংক্রান্ত আলোচনা দার্শনিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে।প্লেটোর দর্শন মনোবিজ্ঞানকে বিতর্ক ছাড়া কিছুই উপহার দেয়নি। প্লেটো বলতেন মনই চরম সত্য, এবং অন্যসব বস্তু মনের প্রতিরুপ।প্লেটো মন বা আত্মাকে দুটি ভাগে ভাগ করেন।একটি হল যুক্তি বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা, আরেকটি হল অযৈাক্তিক আত্মা থেকে সৃষ্টি হয় আমাদের ক্রোধ, কাম, ভীতি,  আশা, বেদনা, ও আনন্দ। যৈাক্তিক আত্মার সাথে অযৈাক্তিক আত্মার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে অযৈাক্তিক আত্মা প্রাধান্য বিস্তার করে।সুতরাং মানসিক ব্যাধি হল অযৈাক্তিক মনের কাজ।সুতরাং চিকিৎসা হল দার্শনিক উপদেশ দানের মাধ্যমে তার যৈাক্তিকতা ফিরিয়ে আনা।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আরেকজন লেখক সেলসাস, তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারনা তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তীকালে, বিংশ শতাব্দীতে এসে পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে।ধারনাটি ছিল এই যে, মানসিক ব্যাধি ব্যাক্তির শরীরের কোন একটি অঙ্গকে প্রভাবিত করে না বরং সমস্ত ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য অমানবিক ও নিষ্টুর ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন যা তখনকার দিনের প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। মধ্যযুগ যতই অগ্রসর হতে থাকে, মানসিক ব্যাধিকে ততবেশি করে ‘পাপ” হিসেবে গন্য করা শুরু হয়। এ পাপ ছিল প্রধানত যৌন আকাঙ্খার ফল। অশরীরী শয়তান, যাদের বলা হতো ইনকুবি-এরা মহিলা ও অন্যান্য লোকদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত।যেমনঃ  যৌন অক্ষমতা, বন্ধাত্য, গর্ভপাত, ইত্যাদি।এমন কি ঈর্ষা, শারীরিক ব্যাধি, এবং চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া- সব ধরনের অসুস্থতার জন্যই শয়তানকে দায়ী করা হত।১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে পোপ জোহানহাইনরিখ নামক দুজন ধর্ম প্রচারককে দায়িত্ব দেন যাদুবিদ্যা ধমন করার জন্য।তখন উক্ত দুজন ব্যক্তি একটি তথ্যপূর্ণ বই লেখেন –যার নাম মেলিয়াস মেলিফিকেরাম অর্থাৎ ডাইনিদের হাতুড়ি।এই বইটিকে তখন ডাইনিদের শনাক্ত করার জন্য এবং শাস্তি দেয়ার জন্য ম্যানুয়েল হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।প্রায় আড়াইশত বছর এই বইটি ডাইনিদের শনাক্তকরন, বিচারকরন,শাস্তি দেয়া,অপরাধী হিসেবে প্রমানিত করা,দন্ডাদেশ দেয়া,এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য নির্দেশক পুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হত।কিন্তু যাদের এভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছিল, আজকের দিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে  তারা সবাই ছিল মানসিক রোগী।

মেলিয়াসে বলা হয়েছে,সব ডাইনিপনার উৎপত্তি হয় অদম্য যৌন কামনা থেকে।মেয়েদের যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকে অসীম এবং অতৃপ্ত ।সেজন্য তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরনের জন্য প্রেত/শয়তানের সাথে যোগসাযস করে।

এই তত্ত্ব থেকে অনেক মহিলা মানসিক রোগীকে পুড়িয়ে মারার জন্য যুক্তি দেখানো হত যে,তাদের দেহকে শয়তানের কবল থেকে মুক্ত করা হয়েছে।অর্থাৎ ডাইনিকে হত্যা করে তাকে মুক্ত করা হয়েছে।

রেনেসাঁ এবং প্রেততত্ত্ব থেকে উত্তরণঃ  সব শেষ ডাইনিকে হত্যা করা হয়েছিল জার্মানিতে ১৭৭৫ সালে এবং সুইজারল্যান্ডে ১৭৮২ সালে।  অনেক দেশে এবং  আমাদের দেশে ভূত তাড়ানোর নাম করে এই এখনও অনেককে হত্যা করা হয়। যাহোক, ষোড়শ শতাব্দীতে মানুষের চিন্তার জগতে নবযুগের সূচনা হয়।এবং কিছু কিছু লোক মেলিয়াসের এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।জোহান ওয়েয়ার (১৫১৫-১৫৭৮) কে মেলিয়াসের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী কণ্ঠস্বরের সর্বপ্রথম প্রতিনিধি বলা যায়।তিনিই এতিহাসের সর্ব প্রথম চিকিৎসক যার প্রধান আগ্রহ ছিল মানসিক রোগের প্রতি।তিনি  ঘোষনা করেন যে,‘বেশির ভাগ ডাইনি প্রকৃতপক্ষে নিরপরাধ এবং অসুস্থ ব্যক্তি” আমি প্রমান দিচ্ছি যে, যেসব অসুস্থতা বা ব্যাধির জন্য ডাইনিদের দায়ী করা হয়, সেগুলো প্রাকৃতিক কারন থেকে সৃষ্টি হয়। জোহান ওয়েয়ার লেখাগুলো পরবর্তীকালে মানসিক রোগের বর্ণনার জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ যুগের সবচেয়ে বেশি লোকের প্রতিনিধি ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস- যিনি যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে ১৬৬৫ সালে একটি মেলিয়াসের সমালোচনা করে একটি পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন.১৭০০ সালের কাছাকাছি এসে প্রেত তত্ত্বের উপর লোকের বিশ্বাস কমে আসে এবং তার প্রায় পঞ্চাশ পর প্রেত তত্ত্বের মৃত্যু ঘটে।

আধুনিক যুগ

আধুনিক যুগকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃপ্রথম ভাগে মোটামুটি ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এই সময়ে জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল ছিল। দ্বিতীয় কাল পর্ব শুরু হয় ১৮০০ সাল থেকে যখন জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোচ্চ শিখরে আলোড়ন করেছিল তার থেকে বর্তমান কাল পর্যন্তআধুনিক যুগের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য হল মানসিক রোগের কারন হিসেবে মানসিক শর্তাবলীকে প্রাধান্য দেয়া।

জৈবিক যুগ

ষোড়শ শতাব্দীতে শরীর সংস্থান এবং শারীরবিদ্যায় যে প্রভূত উন্নতি সূচিত হয়, তাই অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানে জৈবিক যুগের সূচনা করে।এই যুগের প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন উইলহেলম গ্রিসিঞ্জার (১৮১৭-১৮৮০) এবং এমিল কেপেলিন (১৮৫৬-১৯২৬) তাদের আগেই বেশ কয়েকজন সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিলেন যে, স্নায়ুতন্ত্রের ক্লান্তি, মস্তিষ্কের আকার এবং আকৃতি , মস্তিষ্কের কোষ –কলার ধ্বংস ,বংশ গতি সন্তান প্রসব,মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া ইত্যাদি কারন থেকে আবেগীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।গ্রিসিঞ্জার ছিলেন একজন জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট।তিনি মানসিক রোগ সম্পর্কিত সব ধরনের পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্য বা অনুমান সমুহ সংগ্রহ করেন এবং এগুলো ১৮৪৫ সালে তার একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেনবইটির নাম mental pathology and therapeutics. এই বইটি মানসিক রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রথম বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বলা যায়।এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, সব ধরনের মানসিক ব্যাধির কোন মানসিক কারন নেই। সব মানসিক ব্যাধি প্রকৃত পক্ষে শারীরিক ব্যাধি –যার মূলকেন্দ্র হল মস্তিষ্ক।ক্রেপেলিন গ্রিসিঞ্জারের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন ও তার তত্ত্ব অনুসরন করে মানসিক রোগের একটি শ্রেনীবিন্যাস পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।ক্রেপেলিন এর মুল স্বীকার্য চিল যে,মানসিক ব্যাধির ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত। তিনি মনে করতেন মানসিক রোগকে তার পরিনতি ও গতিবিধি দ্বারাই শনাক্ত করা যায়। রোগীর অনুভূতি, চিন্তা, এবং আকাংখা ও উদ্বেগ হল আকস্মিক ও অপ্রাসঙ্গিক। ক্রেপেলিন তার শ্রেনীবিন্যাসে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিসের এবং কিশোর বয়সের মনো বিকৃতি ইত্যাদি রোগের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন।ক্রেপেলিন সব ধরনের মানসিক ব্যাধির জন্য মস্তিষ্কের ক্ষয়ক্ষতি বা রোগকে ,অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির অস্বাভাবিক ক্রিয়াকে বিপাক ক্রিয়ার ত্রুটিকে অথবা বংশ গতিকে দায়ী করেছিলেন।এক কথায় ক্রেপেলিন এর মতে জৈবিক শর্তই মানসিক ব্যধির কারন।এই দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তেও তার শ্রেনীবিন্যাস এবং প্রতীকটি শ্রেনীর জন্য লক্ষন সমূহের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছিলেন তা মনোচিকিৎসার আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়েছিল।এর পর অনেক বছর পর ১৯৮০ সালের দিকে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক সমিতি একটী নতুন শ্রেনীবিন্যাস প্রবর্তন করেছে যা DSM_ নামে প্রকাশিত হয়েছে। সর্ব শেষ শ্রেনীবিন্যাস প্রকাশিত হয়েছে DSM_5 নামে ২০১৩ সালে।

বেঞ্জামিন রাস ছিলেন সর্বপ্রথম আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট, যিনি আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষনার স্বাক্ষর করেছিলেন, তিনিও সেলসাস এর সঙ্গে একমত হয়ে মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার জন্য বমন সৃষ্টিকারী ঔষধ জোলাপ এবং রক্তমোক্ষন পদ্ধতিকে সমর্থন করেছিলেন।জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট জোহান রেইল ছিলেন একজন বিদগ্ধ চিকিৎসক। কিন্তু তিনিও মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য মৃদু অত্যাচার এর পক্ষে প্রচার করেছিলেন।লন্ডনের বেথলেম হাসপাতালের মত একটি আদর্শ হাসপাতালেও মানসিক রোগীদের ঠান্ডা কুঠরীতে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো,তাদের পুষ্টিকর খাবার দেয়া হতো না।জেলখানার ধর্ষকামী কর্মচারীরা  রোগীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য লেলিয়ে দিতো এবং অল্প প্রবেশ মূলের বিনিময়ে বহিরাগত লোকদের এ ধরনের মারামারির দৃশ্য প্রদর্শন করতো। এজন্য বেথলেম হাসপাতালের নামটি বিকৃত করে বেডলাম বলে ডাকা হতো।এই হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য রোগীদের দম ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পানিতে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে রাখা হত, এবং একটি ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে ঘুরানো হত-যতক্ষন না সে অচেতন হয়ে পড়ত।ধারনা করা হত যে, এভাবে ঘুরানো হলে রোগীর মস্তিষ্কের কোষগুলো পুনরায় সুসজ্জিত বা সুবিন্যস্ত হবে এবং মস্তিষ্ককে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসবে।মানসিক রোগীদের মুক্ত পরিবেশে রাখার জন্য, বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য, সর্বপ্রথম সরকারী অনুমতি আদায় করেছিলেন ১৭৯৩ সালে ফরাসি সাইকিয়াট্রিস্ট ফিলিপ পিনেল (১৭৪৫-১৮২৬)প্যারিসের লা বিকটরে হাসপাতালে।প্যারিসের নাগরিকগণ সবিস্ময়ে  দেখলেন যে, এসব মানসিক রোগীদের শেকল খুলে দেওয়ার পর তারা মোটেই বিশৃঙ্খল, আক্রমনাত্মক আচরন করেনি বরং শান্ত শিষ্ট ছিল।পিনেল যেসব মনিষীর চিন্তা ধারায় উৎসাহ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে এস্ক্লেপিয়েডস থেকে শুরু করে করে বেলজিয়ামের ঘিল শহরের অনেক নাগরিক ছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে একটী রেওয়াজ  শুরু হল যে, মানসিক রোগীরা তাদের চিকিৎসার জন্য ঘিল শহরের একটি ধর্মশালায় যেত। কেউ আবার তীর্থযাত্রার নাম করে শহরের বাসিন্দাদের গৃহে আশ্রয় নিতেন ।আজও সেখানে একটি কলোনী  রয়েছে যেখানে হাজার হাজার মানসিক রোগী বসবাস করে, এবং শহরের লোকদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মেলামেশা করে।আমেরিকায় ডোরাথিয়া ডিকস নামের একজন বিদূষী মহিলা দুঃস্থনিবাস ও পাগলাগারদে বা জেলখানায় অবস্থানরত মানসিক রোগীদের অমানুষিক নির্যাতন ও পাশবিক, নিষ্টুর অবস্থার বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন করার জন্য কয়েক দশক ধরে প্রচারনা চালিয়েছেলিন।তার চেষ্টার ফলশ্রুতিতে আমেরিকায় রাষ্টীয় ব্যায়ে ৩০টি  হাস্পাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।

মনোবৈজ্ঞানিক যুগ

১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে বিশুদ্ধ জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই সময় কিছুটা নমনীয় জৈবিক ও মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে একটি মিশ্র বা সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটতে থাকে।মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায় মনোবৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা হয় আংশিকভাবে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অবদানের ফলে,  আর আংশিকভাবে হিপ্নোসিস বা নিদ্রাবেশের আবিষ্কারের ফলে।পিনেল এর লেখায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, মানসিক রোগীরা অন্যান্য সাধারন মানুষের মতই মানুষ।তাদের যখন শেকল খুলে মুক্ত করা হল তখন তাদের আচরন নিয়ে অনেকেই উৎসাহ দেখালেন।এ ধরনের রোগীদের নিয়ে কাজ লরতে গিয়ে ভিয়েনার চিকিৎসক ফ্রেঞ্জ এনটন মেস্মার (১৭৩৩-১৮১৫)হিপ্নেসিস বা সংবেশন ব্যবহার শুরু করেন।

জা মারটিন শারকো নামক একজন ফরাসি সাইকিয়াট্রিস্ট এবং স্নায়ুতত্ত্ববিদ কে আধুনিক স্নায়ুশারীরবিদ্যার জনক বলা হয়।তিনি প্যারিসের সাল পেট্রিয়ার হাসপাতালে নিউরোসিস, বিশেষ করে হিস্টিরিয়ার রূপান্তর প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে সংবেশন বা নিদ্রাবেশ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।কিন্তু তার একটি ভ্রান্ত ধারনা ছিল যে, শুধুমাত্র হিস্টিরিয়ার রোগীদের মধ্যে যেসব অবস্থা লক্ষ্য করা যায়-যেমন সমাধিস্ত অবস্থা, মাংস পেশীর জড়তা বা কঠীনতা প্রাপ্তি, সংবেদনহীনতা, অলীক প্রতক্ষন, এবং প্রতিবতী ক্রিয়ার পরিবর্তন, এগুলো সবই মস্তিষ্কের ক্ষতির ফলে সৃষ্টি হয়।

পিয়েরে জেনে (১৮৫৯-১৯৪৭) খুব বিস্তৃতভাবে হিস্টিরিয়ার লক্ষনাবলী বর্ণনা করেছিলেন এবং সংবেশন সম্পর্কে একটি মতবাদ গঠন করেছিলেন।জেনে মনে করতেন যে হিস্টিরিয়ার রোগীদের মধ্যে যে কারনে অভিভাবনশীলতা বেশী থাকে তাহল এসব রোগীদের বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবনতা –অর্থাৎ বংশগত বা দৈহিক কাঠামোগত প্রবনতা ।তার এই ধারনা সঙ্গে ফ্রয়েডের অবদমন ধারনাটির খুব মিল আছে।জেনের তত্ত্বে কয়েকটি ত্রুটি ছিল।প্রথমতঃ নিউরোটিক রোগের পেছনের কারন হিসেবে জেনে প্রেষনার ভূমিকা ও শৈশবকালীন অভিজ্ঞতার  মধ্যে সম্পর্ক দেখাননি, এবং দ্বিতীয়তঃ নিউরোটিক রোগীদের অনেক ধরনের লক্ষন প্রকাশ করার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রোগী শুধুমাত্র কয়েকটি নির্বাচিত লক্ষন প্রকাশ করে কেন-যেগুলো প্রত্যেক রোগীর বেলায় আলাদা হয় এসব প্রশ্নের কোন তাত্ত্বিক ব্যখ্যা বা উত্তর জেনে দিতে পারেননি।জেনের তত্ত্বের এ ত্রুটিগুলো দূর করেছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯).১৮৯৫ সালে ব্রুয়ার এবং ফ্রয়েডের যৌথ গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন (Studies in Hysteria)  প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তারা নিউরোটিক রোগীদের যেসব লক্ষন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন,সেগুলোকে ব্যখ্যা করার জন্য তাদের মনোসমীক্ষন তত্ত্বের প্রাথমিক রূপরেখা প্রণয়ন করেন।তারা অনুমান করেছিলেন যে, শৈশবের অভিজ্ঞতার ফলেই নিউরোসিস হয়, কতকগুলো অতীত অভিজ্ঞতার অবদমন বা বিস্মৃতি ঘটে, এবং এগুলো অবচেতন স্মৃতি তৈরি করে।এসব অবচেতন আকাঙ্খা থেকেই নিউরোটিক রোগের লক্ষন সৃষ্টি। অচিরেই ফ্রয়েড নিউরোসিসের চিকিৎসায় সংবেশনের প্রয়োগ বাতিল করে এবং তার বদলে মুক্ত অনুষঙ্গ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।এই পদ্ধতিতে রোগীকে মনে যা আসে তাই অবাধে বলতে বলা হয়।তারপরের ৪০ বছর ফ্রয়েড তার রোগীদের অনুষঙ্গসমূহ সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলোর উপরে ভিত্তি করে তার অভিজ্ঞতাভিত্তিক মনোসমীক্ষন তত্ত্ব সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলোর উপরে ভিত্তি করে তার মনোসমীক্ষন তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন।ফ্রয়েড মানুষের ব্যক্তিত্বের তিনটি স্তরের কথা বলেছিলেন- যেগুলোর একটি ইদ বা জৈবিক সত্তা, আরেকটি ইগো বা বাস্তব জ্ঞান কিংবা অহং সত্তা এবং বিবেক ।মানুষ এই তিনটি সত্তার সমন্বয়ে গঠিত এবং এই তিনটি সত্তার মধ্যে সব সময় দ্বন্দ্ব সংঘঠিত হচ্ছে।প্রত্যেকটি মানুষকে এই তিনটি সত্তার মধ্যে অর্থাৎ তার তাগিদ গুলোর সঙ্গে এবং অবদমনগুলোর সঙ্গে বাস্তব জগতের নীতিগুলোর সমন্বয় সাধন করে, ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়।এটা হল এক ধরনের সমঝোতা স্থাপন । কিন্তু নিউরোটিক রোগীরা এই সমঝোতা স্থাপনে  ব্যর্থ হয়।নিউরোটিকদের লক্ষনগুলো তাদের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের প্রতিফলন বা বহিঃ প্রকাশ –যে দ্বন্দ্ব গুলোকে তারা মিটিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। মনোসমীক্ষন একটি তত্ত্ব হিসেবে এবং চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবেও প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সর্বজন গ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারেনি।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পীড়ন বা চাপ এত এত প্রবল হয়েছিল যে হাজার হাজার সৈনিকদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় ঘটেছিল এবং তাদের মধ্যে হিস্টিরিয়ার লক্ষন দেখা দিয়েছিল।অনেক পর্যবেক্ষকদের নিকট মনে হয়েছিল যে, ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব অপ্রত্যাশিত গণ বিপর্যয়ের ঘটনাটিকে অন্যান্য তত্ত্বের চেয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল। এরপর থেকে আমেরিকায় ও বিশ্বের অন্যত্র মনোসমীক্ষন তত্ত্ব মনোবিজ্ঞান ও সাইকিয়াট্রির উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।মনোসমীক্ষন তত্ত্বের কিছু সংশোধন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে পরবর্তীকালে।১৯০৮ সালে ক্লিফোরড বীয়ারস মানসিক হাসপাতালে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একটি বই লিখেন।বইটির নাম ছিল’ যে মন নিজেক খুঁজে পেয়েছে।এই বইয়ে আমেরিকান হাসপাতালগুলোতে যে কি দুর্বিষহ অবস্থা ছিল তা তুলে ধরেন।এর ফলে আমেরিকায় ১৯০৯ সালে মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের সূচনা হয়।এই আন্দোলনের ফলে মানসিক হাসপাতাল বা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্যমান হাসপাতাল গুলোর পরিবেশ উন্নত করার জন্য, সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের মানসিক চিকিৎসা করার জন্য এবং চিকিৎসার মান উন্নত করার জন্য গোষ্ঠীভিত্তিক প্রচেষ্ঠা শুরু হয়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে ১৯১৪ সালে রাশিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ আইভান প্যাভলভ কর্তৃক পরীক্ষণ মূলক নিউরোসিস আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।প্যাভলভ আবিষ্কার করেন যে, একটি কুকুরকে যদি দুটি প্রত্যক্ষনমূলক অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে দেওয়া হয়, যা অত্যন্ত কঠিন –যেমন একটি বৃত্ত ও একটি প্রায় একই আকৃতির  উপবৃত্তের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে –তখন প্রানীটি চিৎকার করে, আক্রমণাত্মক আচরন করে।এই ধরনের ঘটনাকে প্যাভলভ পরীক্ষনমূলক নিউরোসিস বলেছিলেন।তারপরে প্রমানিত হয়েছে যে,একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হলে ইঁদুর, বানর এবং শিম্পাঞ্জীদের মধ্যেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।এর তাৎপর্য হল এই যে মানুষকেও যদি এ ধরনের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন করা হয় –যেখানে সে সহজে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না- অর্থাৎ যখন তার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় –তখন তার অভিযোজন ক্ষমতার উপরে পীড়ন সৃষ্টি হয় এবং সে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এই বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আরো বেশি হয়, তখন তার সিদ্ধান্তগুলো সামাজিক ও আবেগীয় ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়. অতি  সাম্প্রতিক কালে অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বা মনোদৈহিক দৃষ্টিভঙ্গি অথবা ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।  এই দৃষ্টিভঙ্গিতে নিশ্চিত করা হয় যে, মানসিক ব্যাধির কারন হিসেবে জৈবিক শর্তাবলী কে যেমন উপেক্ষা করা যাবে না তেমনি মানসিক শর্তাবলীকে ও অস্বীকার করা যাবে না।এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রচলন ঘটেছে প্রখ্যাত আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট এডলফ মেয়ার (১৮৬৬-১৯৫০)এর অবদানের ফলশ্রুতিতে।মেয়ার যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তা হল, একজন রোগীর লক্ষনাবলীর প্রতি নজর না দিয়ে আমাদের উচিত রোগীকে এবং তার ব্যক্তিত্বের অন্যান্য সব দিক দিয়ে অনুধাবন করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব সৈনিক মানসিক বিকৃতিতে ভুগছিল, তাদের অনেকের জন্য প্রধানত দায়ী ছিল মনোশারীরবৃত্তীয় কারন। ১৯৩০ সালের দিকে কতকগুলো নতুন শারীরিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ায় অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৯৬০ এর দশকে উন্নত দেশগুলোতে গোষ্ঠীভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সময়  পর্যন্ত অস্বাভাবিক আচরন নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা, গবেষনা, নতুন নতুন চিকিৎসা উদ্ভাবন চলছে।

 

লিখেছেন – জাকিয়া সুলতানা

Loved this article? Share with your community and friends.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share