হিউম্যানিস্টিক থেরাপি

Share

থেরাপি বলতে সাধারণত এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে যেখানে একজন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত, দক্ষ ও লাইসেন্সধারী থেরাপিস্টের সহযোগিতায় মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলো, যেমন-বিভিন্ন মানসিক সমস্যা,মানসিক আঘাত ইত্যাদি সমাধান করার পাশাপাশি নিজের ইতিবাচক চিন্তাকে ত্বরান্বিত করা ও কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে দক্ষভাবে মোকাবেলা করার উপায়গুলোর দিক নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোর জন্যে থেরাপিস্টরা বিভিন্ন ধরনের থেরাপি ব্যবহার করে থাকেন। এটি মূলত থেরাপিস্টের ব্যক্তিগত চয়েস, রোগীর সমস্যার ধরণ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে থাকে। মানসিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যে সকল থেরাপি প্রদান করা হয় তার মধ্যে বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম জনপ্রিয়ও থেরাপি হচ্ছে ‘হিউম্যানিস্টিক থেরাপি’।

হিউম্যানিস্টিক থেরাপি কি?

হিউম্যানিস্টিক থেরাপি হলো এমন একটি থেরাপি যা ব্যক্তিকে তার নিজস্ব অনুভুতিগুলো বুঝতে, তার জীবনের অর্থের অনুভূতি লাভ করতে এবং নিজের সম্ভাব্য ইতিবাচক দিকগুলো বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। একজন হিউম্যানিস্টিক থেরাপিস্ট কোন ব্যক্তিকে থেরাপিস্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তাকে দেখার চেষ্টা করে থাকেন। এ থেরাপিতে ব্যক্তির মধ্যকার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য এবং আচরণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। তাছাড়াও ব্যক্তির সহজাত বৈশিষ্ট্য এবং আচরণগুলো তার নিরাময়ের ক্ষেত্রেও সাহায্য করে থাকে।

হিউম্যানিস্টিক থেরাপিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ, সমবায় আচরণে বিশ্বাসী এবং গঠনমূলক।তারা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ স্বেচ্ছায় তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং তাদের ব্যক্তিগত সম্ভাব্যতা পূর্ণ করে থাকে। মানুষ তার প্রতিভা এবং সম্ভাব্যতাগুলোর স্বীকৃতি চায়। এজন্যে তারা নিজেদের দূর্বলতাগুলোর পাশাপাশি সবল দিকগুলোর জন্যেও অন্যের কাছে থেকে স্বীকৃতি আশা করে। এ ধরনের আচরণ মানুষকে সাহসী, স্বতঃস্ফূর্ত, এবং স্বাধীন হতেও সাহায্য করে থাকে।

হিউম্যানিস্টিক থেরাপির লক্ষ্য

এ থেরাপির মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তির মাঝে তার নিজের সম্বন্ধে একটি শক্তিশালী সত্ত্বার সৃষ্টি করা, নিজের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে নির্ণয় করা যাতে করে সে তার জীবনের অর্থ বুঝতে পারে। এ থেরাপি ব্যক্তির স্বতন্ত্রতার উপর বেশি মনোযোগ দেয় এবং সেই সাথে নন- জাজমেন্টালভাবে ব্যক্তিকে থেরাপি দেয়া হয়ে থাকে।

হিউম্যানিস্টিক থেরাপির ইতিহাস

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব এবং বি.এফ. স্কিনারের আচরণবিধির সীমাবদ্ধতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিউম্যানিস্টিক মনোবিজ্ঞান প্রবল হয়ে উঠেছিল। সক্রেটিস থেকে রেনেসাঁস- এ পুরো সময়কাল জুড়ে নিজের দক্ষতাকে উপলব্ধি এবং প্রকাশ করার প্রক্রিয়া, এবং ব্যক্তিদের সৃজনশীলতা, প্রতিভা প্রকাশের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিলো। ১৯৪৩ সালে মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো মানুষের চাহিদা এবং অনুপ্রেরণাগুলোর উপর ভিত্তি করে একটি তত্ত্ব প্রদান করেন।

Carl Rogers
Carl Rogers

পরবর্তীকালে, ১৯৪৬ সালে কার্ল রজার্স ‘Significant aspects of client-centered therapy’ বা ‘ক্লায়েন্ট-সেন্টারড থেরাপি’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করেন।এতে তিনি এমন একটি থেরাপির উল্লেখ করেন যেখানে একটি উষ্ণ ও সহায়্ক পদ্ধতিতে ক্লায়েন্টকে মানসিক সেবা প্রদান করা হতো। অবশেষে, ১৯৫০ দশকের শেষের দিকে মনোবিজ্ঞানীরা আচরণগত মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপিগুলোর নেতিবাচক দিকগুলো অনুধাবন করতে পারেন। এই নেতিবাচক দিকগুলো অনুধাবনের মধ্যে থেকেই মূলত হিউম্যানিস্টিক থেরাপির মূলভাবনার সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আব্রাহাম মাসলো এবং কার্ল রজার্সের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে হিউম্যানিস্টিক মনোবিজ্ঞান এবং হিউম্যানিস্টিক থেরাপীর সূত্রপাত ঘটায় যা তৎকালীন সময়ে মনোবিজ্ঞানে “তৃতীয় শক্তি” হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

কখন হিউম্যানিস্টিক থেরাপি ব্যবহার করা হয়?

আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবচেয়ে কমন সমস্যাগুলো নিয়ে হিউম্যানিস্টিক থেরাপি কাজ করে থাকে। এটি একজন ব্যক্তির সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে কাজ করে থাকে। এটি সাধারণত যে সকল বিষয়ের উপর কাজ করে থাকে, তা হলো-

  • ডিপ্রেশন
  • প্যানিক ডিসঅর্ডার
  •  উদ্বেগ
  •  পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার
  •  সিজোফ্রেনিয়া
  •  মাদকাসক্তি
  •  সম্পর্কের সমস্যা
  • পারিবারিক ইস্যু
  • ব্যক্তিগত উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি।

এ থেরাপি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, লিঙ্গ সম্পর্কিত সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্বগুলিতেও প্রয়োগ করা হয় । এছাড়াও যারা নিজেদের বর্তমান সত্ত্বা নিয়ে সন্তুষ্ট নন, নিজের সত্ত্বার পূর্ণতা সম্পর্কে অনুভূতিহীন এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ নিয়ে সন্ধিহান, তারা এ থেরাপি থেকে উপকার পেতে পারেন।

হিউম্যানিস্টিক থেরাপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

– সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেশন (Self-Actualization):

মানুষের তার নিজের পূর্ণ সম্ভাবনাকে উপলদ্ধি করতে পারাকেই মূলত এটি কেন্দ্র করে থাকে। মানুষ নিজে কি কি করতে সক্ষম তা বুঝতে পারা, জীবনের উদ্দেশ্য উপলদ্ধি করতে পারা, জ্ঞান আহরণ করা, তার নিজস্ব সত্ত্বাকে আলোকিত করা এবং নিজের এ আলোকিত সত্ত্বার মাধ্যমে সমাজের আর দশ জনের কল্যাণ করাকেই এটি নির্দেশ করে থাকে। থেরাপিস্ট ব্যক্তির মাঝে তার এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে আরো বেশি কার্যকর করে তোলার চেষ্টা করে থাকে।

– সমানুভূতিঃ

অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি,তার অনুভুতিগুলোর ব্যাপকতা,অবস্থান বোঝার ক্ষমতাকে সমানুভূতি বলা হয়ে থাকে।এটি হিউম্যানিস্টিক থেরাপির একটি অন্যতম অংশ।একজন হিউম্যানিস্টিক থেরাপিস্টকে অবশ্যই সমানুভূতিশীল হতে হবে।এটি ব্যক্তি ও থেরাপিস্টের মাঝে এক ধরনের বোঝাপড়া সৃষ্টি করে থাকে যা থেরাপিকে কার্যকর হতে সাহায্য করে। এটি থেরাপিস্টকে যে কোন বিষয়ে ক্লায়েন্টের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করে।সমানুভূতি ছাড়া থেরাপিস্ট ক্লায়েন্টের কাজ,চিন্তাগুলো বুঝতে অসমর্থ হয় এবং কেবলমাত্র থেরাপিস্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্লায়েন্টকে দেখে থাকে যা এই থেরাপির আসল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।

– ক্লায়েন্টকে শর্তহীনভাবে ইতিবাচক বিবেচনা করা :
ক্লায়েন্টকে নিঃশর্তভাবে বিবেচনা করার মাধ্যমে থেরাপিস্ট ক্লায়েন্টের প্রতি তার কেয়ার প্রদর্শন করে থাকে। এর মাধ্যমে ক্লায়েন্ট মনে করে যে, থেরাপিস্ট তার অবস্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে ভাল বা খারাপ হিসেবে বিবেচনা করছে না, বরং তার কথার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে ক্লায়েন্ট থেরাপিস্টের সাথে তার কথাগুলো শেয়ার করতে আরো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে, ক্লায়েন্ট তার আসল অনুভুতিগুলো আরো ভালভাবে প্রকাশ করতে পারে এবং ক্লায়েন্ট ও থেরাপিস্টের মাঝে এক উষ্ণ প্রফেশনাল সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।

– ক্লায়েন্টের সাথে সত্যতা ও আন্তরিক যোগাযোগ বজায় রাখা

বিভিন্ন ধরনের হিউম্যানিস্টিক থেরাপি:
হিউম্যানিস্টিক থেরাপিস্টরা বিভিন্ন ধরনের হিউম্যানিস্টিক থেরাপি ব্যবহার করে থাকে। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু থেরাপি হলো –
গেস্টাল্ট থেরাপি:
ফ্রেডরিক (ফ্রিৎস) পার্লস উদ্ভাবিত এ থেরাপিটি ব্যক্তির নিজস্ব সত্ত্বাকে চিনে নিতে, তার সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে থাকে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে শেখে, নিজেকে মেনে নিতে শেখে। থেরাপিস্টরা এ থেরাপিতে সাধারণত ‘রোল প্লেয়িং’, ’স্কিলফুল ফ্রাস্ট্রেশন’ অনুশীলন করিয়ে থাকেন।
এ থেরাপিটি মূলত যে সকল ইস্যু নিয়ে কাজ করে, তা হলো-
– সম্পর্কজনিত সমস্যা
– উদ্বেগ
– স্ট্রেস
– ডিপ্রেশন

ক্লায়েন্ট সেন্টারড থেরাপি:
এ থেরাপি ক্লায়েন্টের জন্যে একটি সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করে থাকে যা তাদের আসল পরিচয় পুনরায় র্নির্মাণে সহায়তা করতে পারে। ক্লায়েন্টের আশেপাশের মানুষেরা তার যে কোন ব্যবহার বা কাজকে সবসময় ভাল বা মন্দ হিসেবে বিচার করে- এই দৃষ্টিভঙ্গিটি মূলত এ থেরাপিটির সৃষ্টিতে মুখ্য ভুমিকা রাখে। ক্লায়েন্ট তার নিজের সত্যিকার পরিচয় অনুধাবন করার মাধ্যমে নিজেকে সঠিকভাবে বুঝতে শেখে, চিনতে শেখে। একজনের সত্যিকারের পরিচয় পুনরায় র্নির্মাণের কাজটি সহজ নয় এবং এ জন্যে থেরাপিস্টকে অবশ্যই শর্তহীন ইতিবাচক ও সহানুভূতির কৌশলগুলির উপর নির্ভর করতে হবে।
এ থেরাপিটি মূলত যে সকল ইস্যু নিয়ে কাজ করে, তা হলো-
– ডিপ্রেশন
– উদ্বেগ
– আত্মসম্মানবোধ কম হওয়া
– প্রচণ্ড শোকার্ত থাকলে
– ইটিং ডিসঅর্ডার
– নেশাজাত পানীয়তে আসক্তি

এক্সিস্টেনশিয়াল থেরাপি :
এ থেরাপিটি টেকনিক ভিত্তিক পদ্ধতির উপর জোর না দিয়ে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে কতিপয় ইস্যুগুলোকে সমাধান করার চেষ্টা করে থাকে। এ থেরাপিস্ট ব্যক্তিকে তার নিজের জীবনের ও জীবনের সমস্যাগুলোর দায়িত্ব নিজে নেবার জন্যে উৎসাহ দেয় এবং সেই সাথে জীবনকে বৃহৎ অর্থ ও মূল্যের সাথে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে।

সাইকোসিন্থেসিস:
চেতনার একটি উচ্চতর, আধ্যাত্মিক স্তর আবিষ্কার করা মূলত সাইকোসিন্থেসিসের লক্ষ্যে বলে বিবেচিত হয়।

সলিউশন ফোকাসড ব্রিফ থেরাপি:
এ থেরাপিকে সলিউশন ফোকাসড থেরাপি বা ব্রিফ থেরাপিও বলা হয়ে থাকে। এ থেরাপিতে ব্যক্তি জীবনে কি অর্জন করতে চায় তার উপর বেশি জোর দেয়া হয়ে থাকে। থেরাপিস্ট ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করার মাধ্যমে তার নিজস্ব শক্তিগুলোকে এবং সীমাবদ্ধতাগুলোকে বের করতে পারে। যে সকল ব্যক্তি অত্যন্ত লক্ষ্য কেন্দ্রিক এবং যারা আসলেই নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে চায়, তাদের জন্যে এ থেরাপিটি সহায়ক হতে পারে।

কম্প্যাশন ফোকাসড থেরাপি:
এ থেরাপিটি ব্যক্তিকে তার নিজের প্রতি ও সেই সাথে অন্যের প্রতি সহায়ক ভঙ্গিতে অনুভব করতে ও ব্যবহার করতে শেখায়। এ থেরাপিটি প্রাত্যাহিক জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা শেখানোর পাশাপাশি আত্ম সমালোচনার প্রতি তুলনামূলক কম প্রবণ হতে সহায়তা করে।

এ থেরাপিটি মূলত যে সকল ইস্যু নিয়ে কাজ করে, তা হলো-
– শৈশবকালীন অবহেলা, অপব্যবহার এবং বুলিংয়ের শিকার হওয়া
– নিজেকে অন্যের চেয়ে কম হিসেবে মূল্যায়িত করা
– উদ্বেগ
– কাউকে বিশ্বাস করা সংক্রান্ত ইস্যু
– কখনোই নিরাপদবোধ না করা ইত্যাদি

এসকল কতিপয় হিউম্যানিস্টিক থেরাপির মাধ্যমে একজন দক্ষ থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সহযোগিতায় একজন ব্যক্তি তার সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

 

লিখেছেন – সাদিয়া সানজিদা অধরা

Loved this article? Share with your community and friends.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share