মাদকাসক্তি

Share

গত কয়েক দশক ধরেই মাদকাসক্তির পরিমাণ আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতা, এই ব্যাপারে সচেতনতার প্রভাব, তরুনদের মধ্যে নতুন অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ইত্যাদি বিবিধ কারণে মাদক দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহারের হার এখন আগের চেয়ে বেশি। এমেরিকান টিভি সিরিজ “নারকোস” এর কথা মনে আছে? কলম্বিয়ার ড্রাগ লর্ড পাবলো এস্কোবার কিভাবে মাদক ব্যাবসা করে পরিণত হয়েছিল একজন কাল্ট ফিগারে! এখন প্রশ্ন আসতে পারে মাদকাসক্তির প্রকোপ হঠাৎ করে কেনই বা এত বেড়ে গেলো কিংবা একজন মানুষ কেনই বা মাদক গ্রহণ করে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পরে? এর উত্তর জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে মাদকাসক্তি আসলে কি।

মাদকাসক্তি।
মাদকের অপব্যাবহার বলতে এলকোহলসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের চিত্ত-প্রভাবকারী ওষুধ বা মাদকের ক্ষতিকর এবং বিপজ্জনক ব্যবহারকে বোঝায়। এই ধরণের ওষুধগুলোর ক্রমাগত ব্যবহার তৈরি করে একধরনের “ডিপেন্ডেন্স সিন্ড্রোম” বা এদের উপর এক প্রকার নির্ভরশীলতা। এই নির্ভরশীলতা প্রকাশ পায় বিভিন্ন ধরণের শারীরিক, মানসিক এবং আচরণগত প্রকাশভংগির দ্বারা। ব্যাক্তি মাদকদ্রব্যটি গ্রহনের প্রতি একধরনের তীব্র তাড়না অনুভব করে। সে যতই এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবগত থাকুক না কেন, মাদকাসক্ত ব্যাক্তি ক্রমাগত তা গ্রহনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। যদি সে গ্রহন না করে তাহলে তার মধ্যে শুরু হয় শারীরিক এবং মানসিক অস্বস্তি। ব্যাক্তি তখন মাদক গ্রহনটাকেই তার প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে গন্য করে থাকে। মাঝে মাঝে এই পরিস্থিতি এত তীব্র হয়ে যায় যে, শারীরিকভাবে সে অসুস্থ হয়ে পরে।

কিভাবে বোঝা যায় কেউ মাদকে আসক্ত কিনা।
মাদকের প্রতি আসক্তি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। মাদক নেয়ার পিছনের কারণ যাই হোক না কেন, ব্যক্তি খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্যক্তির বুঝে উঠার আগেই তার মাদকের প্রতি সহ্য ক্ষমতা এবং ক্রমাগত এর প্রতি নির্ভরশীলতা শুরু হয়। যখন সহ্যক্ষমতা পুরোদস্তুর আসক্তিতে পরিণত হয়, তখন এর থেকে বের হওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পরে।
যে ধরনের মাদকের প্রতি আসক্তিই তৈরি হোক না কেন, তা কতগুলো লক্ষন প্রকাশ করে। এই লক্ষন গুলো হতে পারে শারীরিক অথবা হতে পারে আচরণগত। অনেকক্ষেত্রে দুই ধরণের লক্ষনই প্রকাশ পায়।

শারীরিক লক্ষন-
১।মাদকাসক্তির কিছু চোখে পরার মত শারীরিক লক্ষন হচ্ছে শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলামের যখন এই মাদক দ্রব্যটি প্রভাব ফেলা শুরু করে। যেমন মাদক ব্যবহারের প্রতি শরীরের যে সহ্যক্ষমতা তৈরি হয়ে যখন ক্রমাগত ধীরে ধীরে আগের তুলনায় বেশি পরিমাণের মাদক সেবন প্রয়োজন হয় পূর্বের অনুভূতি ফিরিয়ে আনার জন্য। এই প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে চলতে এমন এক পর্যায় আসে, যখন ব্যক্তি অপরিমিত মাত্রায় মাদক গ্রহন করা শুরু করে। ব্যাক্তি ক্রমাগত প্রথমবার মাদক সেবনের অনুভূতিটা বার বার অনুভাব করতে চায়। অরথ্যাৎ যা শুরু হয়েছিল প্রথমে একটু খানি মাদক সেবনের মধ্য দিয়ে, তার শেষ হয় আসক্তিতে।  
২। মাদক ত্যাগ বা ডোজ কমালে তীব্র প্রত্যাহার জনিত শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়।
৩। রক্তরাংগা কিংবা মাতাল চক্ষু।
৪। বর্ধিত অথবা সংকুচিত চোখের মণি।
৫। আকস্মিকভাবে শরীরের ওজনের পরিবর্তন।
৬। ক্ষত, সংক্রমন অথবা অন্যান্য শারীরিক চিহ্ন যা শরীরের ড্রাগের অনুপ্রবেশ চিহ্নিত করে।

মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে বাধার সৃষ্টি, ব্যক্তিতে পরিবর্তন, হ্রদক্রিয়া এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি মাদকসেবনের লক্ষন হিসেবে দেখা দেয়।

আচরণগত লক্ষন
অধিক মাদক দ্রব্য সেবনের ফলে ব্যক্তি ক্রমাগত মাদকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরার কারনে তা ব্যক্তির আচরনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাদক ব্যক্তির ব্রেইনের মনোযোগ দেয়ার এবং সংলগ্ন চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
নিম্নলিখিত আচরণগত পরিবর্তন ব্যক্তির মাদকের প্রতি আসক্তিকে নির্দেশ করে-
১। ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন বা উদ্বেগ। সবকিছুর প্রতি একধরনের বিরক্তি।
২। মনোভাব এবং ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন।
৩। ঝিমুনি ভাব।
৪। হতাশা।
৫। অভ্যাসের ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন।
৬। অর্থনৈতিক সমস্যা।
৭। অপরাধী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া।

উপরিক্ত শারীরিক এবং আচরনগত লক্ষন গুলো মাদকাসক্তির প্রতি নির্দেশ করে।

মাদকে আসক্ত কেন হয়?
মাদকদ্রব্য ব্রেইনে এক ধরণের গঠনগত পরিবর্তন সাধন করে বলে মাদক নেয়া রোগীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমাগত ব্রেইন নিজেই মাদকের প্রতি তীব্র আসক্তি অনুভব করে।
আমাদের নিজেদের শরীরে আরো ভাল করে বলতে গেলে ব্রেইনে প্রাকৃতিক ভাবেই এক ধরণের মাদকের উপস্থিতি  বিদ্যমান। এই মাদক বা ড্রাগগুলো আমাদের বাহিরের মাদক শরীরে প্রবেশ করলে যে অনূভুতি দেয় সেই রূপ অনুভূতিই দিয়ে থাকে। এদেরকে একত্রে বলা হয় “Endogenous Addictive Neurone Transmitter”.

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, যদি আমাদের শরীরেই এ ধরণের মাদকের উপস্থিতি থাকে তাহলে আমরা কেন বাহিরের মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হই? উত্তর হচ্ছে ব্রেইনের নিজস্ব মাদকের তুলনায় বাহিরের মাদকের ডোজ বা এর আকর্ষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। যার কারণে যখন কেউ মাদক গ্রহণ করে থাকে সে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে।
বাহিরের মাদক যেমন হিরোইন, আফিম, ইয়াবা ইত্যাদি যখন ভিতরের প্রবেশ করে তখন তা ব্রেইনের বাহক সিস্টেমকে “হাইজ্যাক” করে ফেলে। যার কারণে স্বাভাবিক যে পুরষ্কার তন্ত্র তা মাদকের কাছে জিম্মি হয়ে যায়। মাদকাসক্তরা স্বাভাবিকভাবে জীবন থেকে আর আনন্দ স্ফূর্তি নিতে পারে না। তাদের জীবন তাদের নিজেদের কাছে মনে হয় অনেক একঘেয়ে। আনন্দ আর স্ফূর্তি লাভের আসায় তারা দ্বারস্থ হয় মাদকের ওপর এবং ক্রমাগত হয়ে পরে নির্ভরশীল।
এক কথায় বলতে গেলে, ব্রেইনের Hedonic Capacity (আনন্দ সুখ অনুভব ক্ষমতা) নষ্ট হয়ে যায়।

মাদকাসক্তির কারণগুলো নিম্নে সংক্ষেপে দেয়া হলঃ

১। মন বা ব্রেইনের পুরস্কার/ আনন্দ তন্ত্রের বল বৃদ্ধি হওয়া।  আমাদের শরীরের ডোপামিন নামক এক ধরণের হরমোন বিদ্যমান। এই ডোপামিন হরমোন যাওবতীয় সুখানুভূতি/ তৃপ্তিদায়ক অনুভূতির জন্য দায়ী। এই ডোপামিন যাবতীয় ইতিবাচক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয় (যেমন খাদ্য, পানীয়, যৌনতা)। মাদক গ্রহণ করলে তা ডোপামিন রিলিজ করে শরীরে আনন্দের বন্য বইয়ে দেয়। রোগীরা এক ধরণের শিহরিত অনুভুতি অনুভব করেন। তারা  এক প্রকার “হাই” ভাব পান।

২। মাদক যে শুধুমাত্র ডোপামিন রিলিজ করে আনন্দের শিহরণ দেয় তা নয়। মাদক শরীরের বিভিন্ন ব্যাথা, মানসিক উদ্বেগ ইত্যাদিও হ্রাস করে। যার কারণে মাদক গ্রহনকারীর কাছে মাদক আকরষনীয়।

৩। আশেপাশের বিভিন্ন উপাদানের সাথে মাদক গ্রহনের এক ধরণের কন্ডিশনিং বা যোগসূত্র হয়ে যায়। অর্থ্যাৎ যে স্মৃতি গুলো, যে বন্ধুগুলো, না আবেগ অনুভূতি গুলো মাদক গ্রহনের সাথে যুক্ত, সেগুলো মাদকের আনন্দ সুখের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পরে। এই অনুভূতিগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যক্তি ক্রমাগত মাদক গ্রহণ করে। একটা সময় দেখা যায়, সেগুলো নিজেরাই মাদকের আকর্ষণ বা টান তৈরি করে।

৪। ব্রেইনের ক্ষুধা বর্ধক পর্যায়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।

৫। দুর্বল স্ট্রেস কোপিং স্কিলও মাদকের প্রতি ক্রমাগত আসক্তির জন্য দায়ী।

এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কারণ যেমন Peer Pressure, সম্পর্কে ভাঙ্গন, অর্থনৈতিক ভাঙ্গন, মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদিও মাদক গ্রহনের জন্য দায়ী। তবে এই সবকিছুর পিছনেই রয়েছে মাদকের ভয়ংকর নির্ভরশীল করে ফেলারমত ক্ষমতা।

মাদকাসক্তি নিরাময় যোগ্য?
মাদকাসক্তি একটি নিরাময় যোগ্য ব্রেইনের রোগ। ব্রেইন ক্রমাগত মাদকের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পরে। কিন্তু সঠিক স্টেপ নিলে তা থেকে ধীরে ধীরে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে বের করে আনা সম্ভব। বিভিন্ন রিহ্যাব সেন্টার গুলোতে নানারকম সাইকো থেরেপি, উপযুক্ত চিকিৎসা এবং যত্নের মাধ্যমে মাদকের প্রতি আসক্তি কমিয়ে আনা যায়।

মাদকদ্রব্য এক ভয়ংকর সাপের ছোবলের মতন। এর ছোয়ায় একজন ব্যক্তি থেকে শুরু করে ক্রমে একটি পুরো রাষ্ট্র ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে। প্রথমে একবার সুবার শখ করে চেষ্টা করার পর তার উপর নিরভরশীল হয়ে পরলে তা থেকে বের হওয়া হয়ে পরে কষ্টসাধ্য। তাই আমাদের সবার উচিত মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো।

লিখেছেন – অর্থি

Loved this article? Share with your community and friends.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share