তুহিন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। একদম প্রথম থেকে নিয়মিত ছাত্র হলেও ইদানীং সে ক্লাসে যেতে চায়না। বাবামা কিছু জিজ্ঞেস করেও সেটির কারণ বের করতে পারেনি। অবশেষে একদিন তুহিন তার কাজিনের কাছে এই স্কুলের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টির কারণটি খুলে বলে। তুহিনের ক্লাসমেট সুমন তার বন্ধুদের নিয়ে তুহিনকে প্রতিদিনই উঠতে বসতে জ্বালাতন করে। কোনোদিন খাতা কিংবা জামায় পানি ঢেলে দিচ্ছে কিংবা টিফিনের খাবার কেড়ে নিচ্ছে। তুহিনের চশমা কিংবা ব্যাগ নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি তো নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেক সময় তো শারীরিকভাবে আঘাতও করে বসে। তুহিন প্রতিবাদ করতে গেলে এই অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
“আজ ফেরার পথে ধাক্কা দিয়ে তুহিনকে কাদায় ফেলে কী মজাটাই না নিয়েছি বন্ধুদের সাথে। আরে বন্ধুদের সাথে যদি একটু মজাই করতে না পারলাম তো স্কুলে যেয়ে লাভটা কী? আর আমি তো শুধু মজাই করছি। তুহিন তো এগুলা বুঝতেই চায়না। আরেকটু হলেই কেঁদে দিচ্ছিলো গাধাটা।“ এইসব ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরে আসে সুমন। বাসায় ঢুকেই শোনে তার বাবা-মা ঝগড়া করছে। ধুর, প্রতিদিন আর এই চেঁচামেচি সহ্য হয়না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সুমন। এলাকার বন্ধুদের আড্ডাখানায় যেয়ে বসে সে। সেখানেও ছোটখাটো একটা বিষয়ে মতের অমিল হওয়ায় বন্ধুদের সাথে ঝগড়া লেগে যায় তার।
বন্ধুদের সাথে মজা তো আমরা সবাই করি। কিন্তু সেই মজাটি যখন বন্ধুর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে কিংবা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি যখন বন্ধুর আপত্তি সত্ত্বেও বারবার ঘটতে থাকে তখন সেটিকে বুলিং বলা হয়। প্রধানত দুই ধরণের বুলিং দেখা যায় স্কুলগামী বাচ্চাদের মধ্যে। শারিরীক ভাবে আঘাত কিংবা দলবদ্ধভাবে একজনের উপর চড়াও হওয়ার মাধ্যমেই বুলিং এর প্রকাশ ঘটে। আঘাত করা কিংবা বিভিন্নভাবে ক্ষতির মাধ্যমেই “ফিজিক্যাল বুলিং” এর ঘটনা দেখা যায়। গ্রুপের মধ্যে কাউকে একঘরে করে রাখা, সবসময় তাকে নিয়েই সমস্ত জোকস, তাকে নিয়ে গুজব ছড়ানো কিংবা তাকে উদ্দেশ্য করে বর্ণবাদমূলক কথাবার্তা কিংবা গালিগালাজ; এইসব দ্বারা “রিলেশনাল বুলিং” বোঝানো হয়। এছাড়া স্কুল কলেজ ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে সেক্সুয়াল বুলিং; কিংবা ইন্টারনেটে সাইবার বুলিং বেশ বড় ধরনের সমস্যা। এইসব অপ্রীতিকর ঘটনা পরবর্তীতে ভিক্টিমের মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে বেশ বড় ধরনের প্রভাব ফেলে থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিশ্বের প্রায় ২২% মানুষ যারা বুলিং এর শিকার হয়েছেন তারা বেশ লম্বা সময় ধরে এটির দ্বারা প্রভাবিত হন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি ৫০ বছর পর্যন্ত যেতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে শতকরা ২৭ জন চাইল্ডহুড বুলিং এর ফলাফল হিসেবে পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারের সম্মুখীন হয় (মিশা কেচেল, ২০১৮)।
একজন মানুষ যখন বুলিড হয় তখন সে শারীরিক বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বেশ কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। সে বন্ধুবান্ধব থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একাকী হয়ে পড়ে; ডিপ্রেশন তাকে ঠেলে দিতে পারে ড্রাগ এ্যাডিকশনের দিকে। বুলিং এর মানসিক ট্রমা, ডিপ্রেশন কিংবা লো সেলফ এস্টিম এর কারণে সে সুইসাইডের দিকেও এগিয়ে যেতে পারে। যখন সে দেখে সে বুলিড হচ্ছে দেখেও কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না তখন তার ভিতরে ট্রাস্ট ইস্যু গড়ে উঠতে পারে। এ্যাগোরাফোবিয়া কিংবা প্যানিক ডিসঅর্ডারের মত সমস্যার পিছনেরও অন্যতম কারণ এই বুলিং (ডিউক ইউনিভার্সিটি, নর্থ ক্যারোলাইনা)। বুলিং এর শিকার হওয়া মানুষ পাবলিকলি কথা বলতে ভয় পায় কারণ স্কুলে হয়তো তাকে অপিনিয়ন জানানোর কোনো সুযোগ দেয় হয়নি কিংবা তার মতামত নিয়ে হাসাহাসি করা হয়েছে। বুলিং এর ইফেক্ট হিসেবে অনেক মানুষই দুঃস্বপ্ন দেখে থাকে।
একজন বুলিং ভিক্টিমকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে সাধারণত কাউন্সেলিং কিংবা কথা বলাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। একজন প্রফেশনালের সাথে কথা বলে কিংবা অন্যান্য মানুষ যারা কিনা বুলিং এর শিকার হয়েছেন এসব মানুষের সাথে কথা বলে নিজের ভয়কে কাটানো যায়। বুলিং ভিক্টিমরা অনেক সময় বুলিড হওয়ার জন্য নিজেকে দোষারোপ করে থাকেন। যার কারণ হচ্ছে লো সেলফ এস্টিম। নিজের মতামতের গুরুত্ব না পাওয়া, সোশ্যাল সার্কেলে যথাযথ মনোযোগ না পাওয়া লো সেলফ এস্টিমের অন্যতম কারণ। এখানে কথা বলার মাধ্যমে ভিক্টিম বুঝতে পারে তার মতামতেরও গুরত্ব রয়েছে। সে নিজেকে গুরুত্ব দেয়া শেখে। বুলিং এর ফলে যে ভিক্টিম পাবলিকলি কথা বলতে ভয় পায় সে আস্তে আস্তে তার ভয়কে কাটিয়ে উঠে।
একজন বুলি বুলিং কেন করে? আমরা প্রায়শই দেখে থাকি ক্লাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ছেলেটি হয়ত ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছেলেকে বুলি করছে। এছাড়া অনেক সময় অবিসিটি (Obesity) কিংবা ইকোনমিক স্ট্যাটাসের কারণেও অনেকে বুলিং এর শিকার হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা বুলিং এর কারণ হিসেবে হাই সেলফ এস্টিম, আগ্রাসী মনোভাব, ক্রোধ, বেড়ে উঠার পরিবেশ ইত্যাদিকে দায়ী করেন। উপরে আমরা দেখতে পাই সুমন তার বাসায় বাবা-মায়ের ঝগড়ার ফলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এখানে বাসার পরিবেশের প্রতি সুমনের প্রতিক্রিয়া কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে না পারার ক্ষোভ ইত্যাদি বিষয় স্কুলে সুমনের বুলি করার দিকে আঙুল তোলে। স্কুলে বুলিং-এর ফলে সে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে এবং সেখানে সেই যেকোনো কিছুর কেন্দ্রবিন্দু এবং বুলিং করে সে নিজে আনন্দ পাচ্ছে এসব কারণই তাকে বারবার অন্যদের বুলি করতে উৎসাহিত করে।
আমাদের সমাজে মানুষ সাধারণত যে বুলিড হচ্ছে তার দিকেই বেশি নজর দেয়। কিন্তু আমরা চাইলেই যে বুলি করছে তার দিকেও একটু খেয়াল রেখে তার বুলিং এর কারণ বের করতে এবং বুলি করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারি। একজন বুলি সাধারণত রাগ, ক্ষোভ এবং অল্পবিস্তর ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে থাকেন। কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে তার চিন্তাধারা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে তাকে বুলিং এর ক্ষতিকর দিক সমূহ সম্পর্কে বোঝানো যেতে পারে। এছাড়া একজন বুলির মধ্যে নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটির কিছু লক্ষণও দেখা যায়। এক্ষেত্রে তাকে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া কিংবা অন্যের অসুবিধা বুঝতে পারা সম্পর্কে সাহায্য করা যেতে পারে। তার মধ্যে সিমপ্যাথি এমপ্যাথি ইত্যাদি গুণ গড়ে তুলতে সাহায্য করা যায়।
বুলিং সারাবিশ্বেই একটি সাধারণ ঘটনা হলেও ব্যাক্তির মানসিক সুস্থতার উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। আমাদের পাশের মানুষটিই হয়তো তার সোশ্যাল সার্কেল থেকে বিচ্ছিন্ন এই বুলিং এর কারণে; কিংবা সে নিজেই হয়তো একজন বুলি। বুলিং এর ভিক্টিম অথবা বুলিং এর জন্য দায়ীকে বুলিং এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা আমাদেরই দায়িত্ব।
অনেকে আছেন নিজের কথা শেয়ার করার জন্য ‘right person’ কে পাচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে itsokay website একটি ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম। এখানে আপনি পরিচয় গোপন রেখে আপনার কথা বলতে পারেন এবং আপনার মত আরো অনেক জনকে পেতে পারেন যার সাথে আপনি নির্দ্বিধায় মনের কথা খুলে বলতে পারেন।