পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার

Share

গত আগস্টে মায়ানমার থেকে অত্যাচারিত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলো মামুন। চোখের সামনে তার বাবাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, তার মাকে ধর্ষণ করেছে ঐদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সে বহু কষ্টে তার ছোট ভাইকে নিয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছে। এখনো সে রাতে ঘুমাতে পারে না, দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়, সবসময় অস্থিরতায় ভোগে, সে এখনো ভয়ে থাকে এই বুঝি মায়ানমারের সেনাবাহিনী এসে আবার একইরকম অত্যাচার চালাবে।

মামুনের এই ভয় লাগা, আশঙ্কায় থাকাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়ে থাকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। সাধারণত কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানবিক বিপর্যয়ের ফলে মানসিকভাবে অস্থিরতা ভোগা মানুষজন এই মানসিক রোগের শিকার হয়ে থাকে। অনেক সময় এই রোগটির লক্ষণ দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই দেখা যায়, আবার অনেকের ক্ষেত্রে অনেক পরেও আসে।

যেকোন বয়সের মানুষজনই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে, শিশুদের উপরে এর প্রভাব বেশী দেখা যায়। শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষেরা এটার শিকার হয়। চুরি বা ডাকাতির শিকার হওয়া, জটিল কোন রোগে আক্রান্ত হওয়া মানুষজনও এই জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

 

লক্ষণঃ সাধারণত তিন ধরণের লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমত, কোন একটা কাজে যুক্ত থাকার মধ্যেও ঐ ট্রমার কথা মনে পড়ে যাওয়া এবং বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে একদম চুপ হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, কোন জায়গা বা মানুষ দেখে ঐ কষ্টের ঘটনার কথা মনে পড়ে যাওয়া এবং মানুষদের এড়িয়ে চলা। তৃতীয়ত, হঠাৎ করে চমকে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে থাকা।

এছাড়াও আরও যেসব লক্ষণ দেখা যায়-

১। ঐ ঘটনাকে বারংবার মনে করা,

২। চুপচাপ হয়ে যাওয়া,

৩। ঐ ধরণের ঘটনা বা অবস্থা এড়িয়ে চলা,

৪। মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা,

৫। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া,

৬। ঘুমাতে না পারা,

৭। অল্পতেই রেগে যাওয়া,

৮। মানুষজন এড়িয়ে চলা,

৯। সম্পর্ক রক্ষা করতে হিমশিম খাওয়া,

১০। দুঃস্বপ্ন দেখা,

১১। নেতিবাচক চিন্তা বেড়ে যাওয়া,

১২। হ্যালুসিনেশনের শিকার হওয়া,

১৩। কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া,

১৪। মনে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়া,

১৫। রক্তচাপ বেড়ে যায় ও শরীরে কাঁপুনি আসে।

প্রতি ১০০ জনে ৭-৮ জন এই ধরণের মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে, নারীদের ক্ষেত্রে এই হার শতকরা প্রায় ১১জন, যা পুরুষের ক্ষেত্রে ৫-৬। সাধারণত যুদ্ধের মধ্যে থাকা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এই হার বেড়ে যায় ২০-৩০%। আবার জীবনে সবাইই কোন না কোন সময়ে এই রোগের শিকার হয়ে থাকে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, শৈশবে অবহেলার শিকার হওয়া পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হবার মূল কারণ। পুরুষের ক্ষেত্রেও ছোটবেলায় অবহেলা কিংবা শারীরিক নির্যাতন, যুদ্ধকালীন ভয়াবহ স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা এই রোগের কারণ।

প্রতিকারঃ
এই রোগের প্রতিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই। এরপরে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনেরা। নিজে সহজ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, নিজের ইস্যুগুলো নিয়ে বিশ্বস্ত কারও সাথে কথা বলা, নিয়মিত খাওয়া ও ব্যায়াম করা, আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর মাধ্যে দ্রুত এই মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এছাড়াও সাইকোথেরাপী, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপী (সিবিটি), EMDR (Eye Movement Desensitisation & Reprocessing) থেরাপী, গ্রুপ থেরাপী ও মেডিকেশন খুবই কার্যকরী।

(Cognitive Behavior Therapy)
(Eye Movement Desensitization & Reprocessing)

 

লিখেছেন – চয়ন

মাইন্ডফুলনেস

Share

mindfulness-itsokaybd-orthi

মাইন্ডফুলনেস হচ্ছে এমন একটি মানসিক অবস্থা যা কিনা  ইঙ্গিত করে বর্তমান সম্পর্কে এক ধরণের সক্রিয় মনোযোগ ধরে রাখার প্রক্রিয়াকে।

অর্থাৎ যা আমরা করছি , যা আমরা ভাবছি তার সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল বা মগ্ন না থাকা। অতীতে কি হয়েছে বা ভবিষত্যে কি হবে তা নিয়ে পরে না থেকে বর্তমানকে নিয়া চিন্তা করাই মাইন্ডফুলনেস।

যদিও মাইন্ডফুলনেস সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি অবগত আছি, তবুও ইহা আমাদের কাছে আরো সহজলোভ্য হয়ে ধরা দিবে যদি প্রতিদিন নিয়মমাফিক আমরা এর চর্চা করি। অর্থাৎ যদি আমরা মাইন্ডফুলনেসটাকে আমাদের অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে ফেলতে পারি তবেই কিনা এর সর্বচ্চো সুবিধাটা উপভোগ করতে পারবো।

মাইন্ডফুলনেস আমাদেরকাছে সর্বদা প্রাপ্তিযোগ্য। সাধারণ মেডিটেশন প্রোগ্রাম দ্বারাই হোক কিংবা বডি স্ক্যান এর মাধ্যমেই হোক, মাইন্ডফুলনেস আমাদের সব কাজ থেকে একটা বিরতি নিয়ে কিছুক্ষন নিঃশ্বাস ফেলে আশে পাশের পরিবেশ, বিষয়গুলোকে অনুভব করতে শেখায়।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, এই যে আমরা এত মাইন্ডফুলনেসের কথা বলছি, বর্তমানকে অনুভব করার কথা বলছি, এর সুবিধাটা কোথায়? বৈজ্ঞানিকভাবে ৫টী উপকারিতা আছে এই মানিডফুলনেস চর্চার –

  1.      নিজের ব্যাথা, কষ্টটাকে বুঝতে পারা
  2.      আশে পাশের মানুষজন, পরিবেশের সাথে  নিজেকে কানেক্ট করতে পারা
  3.      ইহা আপনার স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে
  4.      মনকে কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে ফোকাস করতে পারা
  5.      ব্রেইনের মধ্যকার অনর্থক বক বক কমানো।

 

মাইন্ডফুলনেস কোনো অস্পষ্ট বা অদ্ভুত ধারণা না। এটা আমাদের মধ্যে বর্তমানে বিদ্যমান এবং আমরা এর উপস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত। আমাদের সকলের মধ্যেই বর্তমানে থাকার সামরথ্য আছে এবং তার জন্য আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করা কোনো প্রয়োজন পরেনা শুধু দরকার একটু চর্চার।যে কেউ যেকোনো অবস্থানে মাইন্ডফুলনেস চর্চা করতে পারে।এর জন্য না আছে কোনো বয়স, শ্রেণী , কাজের বাধা।তাই আসুন আমরা মাইন্ডফুলনেসের মাধ্যমে আশে পাশের সকল বিক্ষেপ থেকে নিজেদের একটু সরিয়ে বর্তমানকে নিয়ে থাকার চেষ্টা করি।

 

লিখেছেন – অর্থি

ডিজলেক্সিয়া

Share

আমীর খান অভিনীত ‘তারে জামিন পার’ সিনেমাটার কথা মনে আছে? পড়তে সমস্যা হয়, লিখতে সমস্যা হয় এমন একটা বাচ্চা ছেলেকে ঘিরে এই সিনেমার কাহিনী আবর্তিত। সিনেমার কাহিনীতে দেখা যায়, ৮বছর বয়সী ঈষান (দারশিল সাফারি) তার স্কুলে নিয়মিতভাবে ফল খারাপ করতেই থাকে, বাড়ির কাজ করে না, ক্লাসে বসে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না এবং এই কারণে তার স্কুলের বন্ধুসহ শিক্ষকদের কাছেও অনেক অপমানিত হয়, টিটকারির শিকার হয়। এমনকি তার বাবা, যিনি কিনা অনেক ভালো চাকুরী করেন তিনিও তার ছেলের এই ধরণের কাজের জন্য তাকে শারীরিকভাবে প্রহার করেন এবং এক সময় ঈষানকে বোর্ডিং(আবাসিক) স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ ঈষানের ভেতরেও একটা রঙ্গীন জগত বাস করে। সে ভাবতে ভালোবাসে, নিজের মত তার একটা জগতের স্বপ্ন দেখে যায় সে নিয়মিত। তার পড়তে ভালো লাগে না, আঁকতে ভালো লাগে না, ভালো লাগে না ক্লাসে বসে থাকতেও। তার এই সমস্যা আর কেউই বুঝতে পারে না। নতুন করে আসা অংকন শিক্ষক আমীর খান তার এই সমস্যাটা বুঝতে পারে এবং ঈষানকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ঈষান লিখতে গেলেই অক্ষরগুলো উল্টো হয়ে যেত, সে দেখতে পেত তার সামনে বইয়ে থাকা লেখাগুলো ছুটে পালাচ্ছে এবং তার মনে লালন করা কোন না কোন প্রাণী বা বস্তুর আকার ধারণ করতো। ঈষানের এই লিখতে না পারার, পড়তে না পারার, আঁকতে না পারার সমস্যাকে বলা হয়ে থাকে ডিজলেক্সিয়া।

ডিজলেক্সিয়া কি? ডিজলেক্সিয়া একটি শিখতে না পারাজনিত সমস্যা। ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিগণ সাধারণত ঠিকমত পড়তে পারেন না, উচ্চারণ করতে পারেন না, পারেন না ঠিকমত লিখতে। তবে, এটি বুদ্ধিমত্তায় কোন ধরণের প্রভাব ফেলে না। সময়ের সাথে নানা ধরণের সাহায্যের মাধ্যমে এই সমস্যা আস্তে আস্তে কমে আসে বলে গবেষণায় দেখা গিয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরণের স্কুলে বা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ ধরণের বই পড়ে ও বিশেষ ধরণের সুবিধায় লিখে এই রোগ ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে যেতে পারে এবং এই ধরণের ব্যক্তিরাও জীবনে সফল হতে পারে। এরা যদিও আস্তে পড়ুয়া হয়, কিন্তু এদের চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক সময় সাধারণ অনেক মানুষের থেকেও বেশী হয়ে থাকে। শতকরা ২০ জনের মধ্যেই এই ধরণের সমস্যা দেখা যায়। এবং সঠিকভাবে পরিচর্যিত ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত মানুষজন জীবনে সফলও হয়। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, আলবার্ট আইনস্টাইন, টমাস আলভা এডিসন, অভিষেক বচ্চনসহ আরও অনেকে বিখ্যাত ব্যক্তিই এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন, এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন।

ডিজলেক্সিয়ার কারণঃ ডিজলেক্সিয়ার জন্য জিন ও পরিবেশ উভয়ই দায়ী। পারিবারিক ইতিহাসে কেউ ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত আছে এমন কোন পূর্ব রেকর্ড থাকলে, ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত ব্রেণের বাঁ অংশ যা কিনা আমাদের কোন কিছু পড়ার কাজে সহায়তা করে থাকে, তাতে কম ইলেক্ট্রিকাল অ্যাক্টিভেশন দেখা যায়। ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত অনেকের গলার মাংশপেশীতেও সমস্যা দেখা যায় যার কারণে তারা ঠিকমত উচ্চারণও করতে পারে না।

ডিজলেক্সিয়ার লক্ষণঃ যেহেতু ডিজলেক্সিয়া কোন নির্দিষ্ট বয়সের মানুষ নয়, যেকোন বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারে। বয়সভেদে ডিজলেক্সিয়ার লক্ষণ বিভিন্নরকম হয়ে থাকে।
প্রি-স্কুল সময়েঃ

১। সহজ ছড়াগুলো বলতে না পারা(যেমনঃ টুংকেল টুইংকেল),

২। বর্ণমালা শিখতে, পড়তে ও মনে রাখতে সমস্যা হয়,

৩। নিজের নামের অক্ষরগুলো পড়তে না পারা,

৪। Cat, Rat, Bat – এর মত সহজ শব্দগুলোও উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়।

১ম শ্রেণীতে পড়ার সময়েঃ

১। ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসা শব্দ বুঝতে না পারা,

২। পড়ার সময়ে শব্দ হারিয়ে যায়,

৩। শব্দের সাথে বর্ণ মেলাতে পারে না।

মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়েঃ

১। খুব ধীরে পড়া,

২। অপরিচিত শব্দ পড়তে সমস্যা হওয়া,

৩। জোরে না পড়া,

৪। পড়ার আগ্রহ কমে যাওয়া,

৫। কোন কিছুর নাম না বলে, “ঐ জিনিস”, “ঐ বস্তু” বলে চালিয়ে দেয়া,

৬। কথা বলতে গেলেই থেমে থেমে যাওয়া এবং “উমম”, “ইয়ে” উচ্চারণ করা,

৭। শব্দ গুলিয়ে ফেলা,

৮। বড়, অপরিচিত শব্দ ভুলভাবে উচ্চারণ করা,

৯। কোন পড়া পড়তে, লিখতে বা প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশী সময় নেয়া,

১০। তারিখ বা অন্যান্য নাম্বার মনে রাখতে না পারা,

১১। বাজে হাতের লেখা,

১২। বিদেশী ভাষা শিখতে সমস্যা হয়।

 

পূর্ণবয়সেঃ

১। মানুষের নাম, জায়গার নাম ভুলভাবে উচ্চারণ করা,

২। পুনরাবৃত্তি করতে সমস্যা,

৩। আনন্দের জন্য পড়া এড়িয়ে চলা,

৪। জোরে না পড়া,

৫। সবাইকে এড়িয়ে চলা,

৬। ‘b’ এবং ‘d’ – এর মধ্যে গুলিয়ে ফেলা,

৭। সবকিছুতে অগোছালো হয়ে পড়া।

 

লিখেছেন – চয়ন

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার

Share

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (Autism Spectrum Disorder-ASD) হলো একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার যা পরিপূর্ণ বিকাশের পথে বিভিন্ন ধরনের প্রকট ও পরিব্যাপক বাঁধার সৃষ্টি করে। ‘অটিজম’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘autós’ যার অর্থ হলো ‘নিজ’ বা self থেকে। অটিজম হচ্ছে অাচরণ সম্পর্কিত অবস্থা, যা জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত শারিরীক,মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ ফাংশানের কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুর ৩ বছর বয়সের মধ্যেই এই আচরণগত সমস্যাগুলো দেখা যায়। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার কোন একটি ডিজঅর্ডার নয়, বরং ‘স্পেকট্রাম’ শব্দটি থেকে আমরা ধারণা পেতে পারি যে এটি কতগুলো ডিজঅর্ডারের সমন্বয়ে সংজ্ঞায়িত হয়েছে।

Diagnostic Statistical Manual for Mental Disorders (DSM-5) এর মতে, অটিজম স্পেকট্রামের অন্তর্ভূক্ত ডিসঅর্ডারগুলো হলো:

অটিস্টিক ডিসঅর্ডার (Autistic Disorder)

অটিস্টিক ডিসঅর্ডার হল অটিস্টিক স্পেকট্রামের অন্তর্ভূক্ত সকল লক্ষণসমূহের সমন্বিত একটি ডিসঅর্ডার।এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির শিক্ষণজনিত সমস্যা থাকে। গড় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একজন মানুষও অটিজমের শিকার হতে পারে। এটাকে “হাই ফাংশনিং অটিজম” বলা হয়ে থাকে।

অ্যাসপারগার ডিসঅর্ডার (Asperger Disorder)

এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝারি কিংবা উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে।এছাড়াও এদের ভাষাসংক্রান্ত সমস্যা থাকতে পারে।

পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার-নট আদারওয়াইজ স্পেসিফাইড ( Pervasive Developmental Disorder-not otherwise specified)

একে ‘Atypical Autism’ ও বলা হয়ে থাকে। এই ডিসঅর্ডারের ডায়াগনসিস সম্পূর্ণভাবে অটিজম ডিসঅর্ডার বা অ্যাসারগার ডিসঅর্ডারের সাথে না মিললেও কাছাকাছি ধরনের সমস্যাগুলো প্রত্যক্ষ হয়।

 

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের ইতিহাস:

‘অটিজম’ টার্মটি সর্বপ্রথম ১৯০৮ সালে করেন একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, ইউজেন ব্লিউলার উল্লেখ করেন। তিনি একজন সিজোফ্রেনিয়ার পেসেন্টকে ব্যাখা রার জন্য সর্বপ্রথম এই টার্মটির ব্যবহার করেন। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের সর্বপ্রথম অগ্রদূত হলেন হ্যানস অ্যাসপারগার এবং লিও ক্যানার। তারা ১৯৪০ সালে তাদের পৃথক কাজের মাধ্যমে এটি নিয়ে গরষণা করেছেন।

১৯৪৩ সালে আমেরিকান শিশুমনোবিজ্ঞানী লিও ক্যানার ১১ জন শিশুকে নিয়ে গবেষণা করে। তার গবেষনায় দেখা যায়, ওই সকল শিশুদের স্মৃতি, সামাজিক যোগাযোগ, শিশুদের দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন, উদ্দীপকের প্রতি সংবেদনশীলতা, সহনশীলতা, খাবারে এলার্জি, বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত দক্ষতা, বক্তার একই কথার পুনরাবৃত্তি সংক্রান্ত সমস্যা দেখা যায়।

১৯৪৪ সালে হ্যানস অ্যাসপারগার আরো একদল শিশুক সেরটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর’ ব্যবহার করা হয়। কারো মাঝে ঘুমের সমস্যা দেখা দিলে তাদের ‘মেলোটনিন’ ব্যবহার হয়। এপিলেপসির সমস্যা দেখা দিলে ‘অ্যান্টিকনভালসেন্ট’ মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। যদি ব্যক্তির মাঝে Attention Deficit Hyperactivity Disorder দেখা যায়, তবে তাকে ” মেলানফেনিডেট” প্রেস্ক্রাইব করা হয়।

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সোশাল লার্নিং প্রোগ্রাম, লেসার অ্যাক্টিভিটি প্রোগ্রাম ব্যক্তির দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে।

 

ASD আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাদের পিতামাতার ভূমিকা অপরিহার্য।থেরাপি এবং মেডিকেশনের পাশাপাশি পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতা ও সহায়তা অনেক বেশি জরুরি যা মাধ্যমে শিশুর অ্যাংকজাংটি অনেকাংশে কমানো সম্ভব ও যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।এক্ষেত্রে পিতামাতার করণীয় হতে পারে-

শিশুকে তার নাম ধরে ডাকা যাতে করে সে বুঝতে পারে যে তাকে সম্বোধন করা হচ্ছে। যতটা সম্ভব কম শব্দের মধ্যে শিশুকে রাখা।

সহজ ভাষায়, ধীরে ও স্পষ্টভাবে তার সাথে কথা বলা

কথা বলার সময় সহজ অঙ্গভঙ্গির ব্যবহার করা শিশুকে কথা বুঝতে দেবার জন্য অতিরিক্ত সময় দেয়া

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের আক্রান্ত ব্যক্তি তুলনামূলক স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

 

পরিশেষে বলা যায় যে, উপযুক্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থা,থেরাপি,মেডিকেশন এবং সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের আক্রান্ত ব্যক্তি তুলনামূলক স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

লিখেছেন – সাদিয়া সানজিদা অধরা

সামাজিক ভীতি

Share

সামাজিক ভীতি (Social Phobia) এর মানে হল সামাজিক পরিস্থিতিতে ভয় লাগা বা অস্বস্তিবোধ করা । এটি কম বেশী সব মানুষেরই লাগতে পারে। তবে কেউ কেউ এতই অস্বস্তিবোধ করেন সামাজিক পরিবেশে, বিশেষ করে নতুন পরিবেশে বা অপরিচিত পরিবেশে যে তারা স্বাভাবিক আচরন করতে পারে না। তাঁরা ঘামতে থাকেন, অহেতুক ভ্য় কাজ করে। ব্যাক্তি সামাজিক পরিবেশে যেতে চায় না।

যা বাক্তির ব্যাক্তিগত , সামাজিক, ও পেশাগত জীবন ব্যাহত হয় , তার কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন একে বলে সামাজিক ভীতি বা সামাজিক উদ্ধেগজনিত বিকৃতি (Social Anxiety Disorder)।

এটা এক ধরনের মানসিক রোগ । এই ভীতিতে আক্রান্ত ব্যাক্তি তাকে মুল্যায়ন করা হবে, তাকে যাচাই করা হবে, অন্য কারও কাছে তার কাজ উপস্থাপন করতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ভয়, লজ্জা , উদ্ধেগ কাজ করে। নতুন লোকের সাথে কথা বলা, জনসমুক্ষে কিছু করতে , নাচ, গান, বক্তৃতা দিতে ভয়, লজ্জা কাজ করে।

সামাজিক ভীতি দুই ধরনের হয়।

যখন ব্যাক্তি একটি পরিস্থিতিতে ভয় পায়, এবং এড়িয়ে চলে, তখন তাকে বিশেষ সামাজিক ভীতি বলে। আর যখন ব্যাক্তি অনেকগুলো সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্ধিগ্ন ও ভীত হয়, তখন তাকে সাধারন সামাজিক ভীতি বলে। যাদের এই ভীতি থাকে , তারা একলা একলা থাকে, সামাজিক পরিবেশে কিছু করতে বা তার যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু যেতে পারে না। মনের ভেতর একটি খুঁতখুঁত ভাব থাকে।আমি হয়তো পারব না বা আমি যদি যাই কি হবে? মানুষ আমাকে দেখে হাসাহাসি করবে। বাকিরা কী ভাবছে? সারাক্ষন তাঁর মনের বেতর এসব চিন্তা হতে থাকে।

এই ভীতির কারন হিসেবে মনোবিজ্ঞনীদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, ব্যাক্তির নেতিবাচক কোন অভিজ্ঞতা, পরিবারের অন্য সদস্য যেমন মা, বাবা, কার ও ভীতি থাকলে ছেলে মেয়েদের মধ্যে আচরনগত শিক্ষা থেকে হতে পারে। এছাড়া যেসব শিশুরা ছোট বেলায় পারিবারিক সংগাত ও টিজিং এর শিকার হয়, অপমান, উপহাস বা কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এছাড়া যেসব বাবা মায়েরা সন্তানদের প্রতি অতি রক্ষনশীল হয়, বা নিয়ন্ত্রন করে ,পরবর্তীতে তারা সামাজিক ভীতিতে আক্রান্ত হয়। জৈবিক কারন হিসেবে বলা হয় , আমাদের মস্তিষ্কে এমিগঢালা (amygdala) নামক একটি অংশ যা ভয় প্রতিক্রিয়া , নিয়ন্থ্রনে ভুমিকা পালন করে। যার একটি অতিরিক্ত এমিগঢালা আছে, তাদের একটি অতিরিক্ত ভয় , উদ্ধেগ কাজ করে, সামাজিক পরিস্তিতিতে তা বৃদ্ধি পায়। এই রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশী শুরু হয় বয়সন্ধিতে, যখন ব্যাক্তির জীবনে সামাজিক সচেতনতা এবং অন্যের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়। শিশুদের মধ্যে ও এই রোগ দেখা যায়।
সামাজিক ভীতিতে আক্রান্ত ব্যাক্তি যেসব শারীরিক প্রতিক্রিয়ার লক্ষন দেখা যায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে বা সামাজিক পরিবেশে কিছু করতে ঘাম হওয়া, বমি ভাব হওয়া, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, মাথা ঘোরা, পেশীতে টান টান অনুভব করা। অনেক সময় জ্বর হয়। পরবর্তীতে বাক্তি যেসব আচরণগত যেসব সমস্যা দেখা যায় , আত্ববিশ্বাসের ওভাব, একাকীত্ব অনুভব করা, সমালোচনা নিতে না পারা, সামাজিক দক্ষতার অভাব , নিজেকে দোষারোপ করা,মাদকাসক্ত হওয়া , আত্মহত্যার প্রচেষ্ঠা ইত্যিদি।

 

সামাজিক ভীতিতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সাধারণত মনোবিজ্ঞানিরা কাউন্সেলিং, ও সাইকথেরাপী, আচরণগত থেরাপী ব্যবহার করে থাকেন ।এছড়াও মানসিক ডাক্তাররাও চিকিৎসা করে থাকেন । সময়্মত সঠিক মানসিক পরিচর্যা পেলে রোগীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠা সম্ভব ।

লিখেছেন – জাকিয়া সুলতানা

 

স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

Share

স্ট্রেস এক ধরনের শারিরীক, মানসিক ও অাবেগ সংক্রান্ত ফ্যাক্টর যা শারিরীক কিংবা মানসিক টেনশনের সৃষ্টি করে। স্ট্রেস সাধারণত ‘flight or fight‘ রেসপন্সের সৃষ্টি করে থাকে। ফ্লাইট সিচুয়েশনে ব্যক্তি স্ট্রেসযুক্ত অবস্থানকে এড়াতে চেষ্টা করে থাকে এবং ফাইট অবস্থানে সাধারণত ব্যক্তি স্ট্রেসযুক্ত অবস্থা সামলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে চেষ্টা করে। স্ট্রেসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি দিয়েছেন রিচার্ড এস. লাজারাস, সেটি হলো – “স্ট্রেস নামক অনুভুতি তখন অনুভূত হয় যখন কেউ অনুধাবন করে যে চাহিদাগুলো তার কার্যকরী ব্যক্তিগত ও সামাজিক সক্ষমতাকে অতিক্রম করেছে।”

স্ট্রেসের সংজ্ঞায় দুইটি মৌলিক উপাদান আছে, প্রথমত, একটি ব্যক্তি এবং পরিবেশের মধ্যে একটি গতিশীল সম্পর্ক। ব্যক্তি স্ট্রেসে কতটুকু প্রতিক্রিয়া করবে তা এই সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, স্ট্রেস জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, বেঁচে থাকলে স্ট্রেস অনুভব করতে হয়।

একজন ব্যক্তির জন্য স্ট্রেস খুব ভালোও নয় আবার খারাপও নয়। স্ট্রেস দুই ধরনের হতে পারে, যেমন: ইউস্ট্রেস বা পজিটিভ স্ট্রেস এবং নেগেটিভ স্ট্রেস বা ডিসস্ট্রেস। পজিটিভ স্ট্রেস জীবনে চ্যালেন্জ এবং উত্তেজনা থাকে। তাই মাঝারি পর্যায়ের অ্যাংকজাইটি, উত্তেজনা এবং একই ধরনের মানসিক কার্যক্রম ব্যক্তির জীবনে বিদ্যমান থাকলে তা স্বাস্থ্যকর। তবে এই স্ট্রেস যখন ব্যক্তিকে কোন স্ট্রেস সম্পন্ন অবস্থানে অনেক বেশি উত্তেজিত করে ফেলে তখন তাকে নেগেটিভ স্ট্রেস বা ডিসস্ট্রেস বলে। এই নেগেটিভ স্ট্রেস জীবনে এক ধরনের অস্বস্তি এবং শারিরীক ব্যাথার উদ্রেক করতে পারে।

স্ট্রেসের শারীরিক লক্ষণসমূহ:
– মাথা ব্যাথা
– বারবার ইনফেকশন হওয়া
– পেশী টানটান অনুভূত হওয়া
– পেশীতে খিঁচুনি
– অবসাদ
– নিঃশ্বাস আটকে যাওয়া
– স্ট্রেসের আচরণগত লক্ষণসমূহ:
– খুব বেশি দূর্ঘটনা ঘটানো
– খাবারে অরুচি
– ইনসমোনিয়া
– অস্থিরতা
– অতিরিক্ত ধূমপান করা
– অতিরিক্ত মদ্যপান করা
– যৌনতাড়না হ্রাস পাওয়া
– স্ট্রেসের আবেগ সংক্রান্ত লক্ষণসমূহ:
– আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া
– অতিব্যস্ত হওয়া
– বিরক্ত অনুভব করা
– ডিপ্রেশন
– ঔদাসিন্য
– নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করা
– কোন কিছু নিয়ে অনেক বেশি সংশয়ে থাকা
– এছাড়া স্ট্রেসে থাকলে ব্যক্তি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে,খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা পরিবর্তন করে, দুঃস্বপ্ন দেখে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে থাকে।

 

স্ট্রেসের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া
আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে দুটি বড় যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে যা স্ট্রেসের সময় সমস্ত শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তার একটি হলো অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম (Autonomic Nervous System) এবং অপরটি হলো এন্ডোক্রাইন সিস্টেম (Endocrine System)।

অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের কাজ
স্ট্রেসের সময় অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম তার দুটি সাকার মাধ্যমে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকে। প্রথমটি হচ্ছে ‘সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম’ যা মূলত জরুরি ফ্লাইট অথবা ফাইট সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং অপরটি হলো ‘প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম’ যা ব্যক্তিকে স্ট্রেস সম্পন্ন অবস্থান থেকে বের হয়ে শান্ত হতে সাহায্য করে।

আমাদের মস্তিষ্কে একটি নার্ভ সেলের সমন্বয়ে গঠিত অংশ আছে, যার নাম হাইপোথ্যালামাস যা অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। স্ট্রেসের সময়ে এই হাইপোথ্যালামাস অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমকে সক্রিয় করে যা শরীরের যে অংশগুলো জরুরি বা স্ট্রেস সম্পন্ন সময়ে কাজ করে তাদের উদ্দীপিত করে থাকে। শরীরের সে অংশগুলো তখন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি কাজ করে থাকে। এটি স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়ায় শরীরের প্রথম প্রতিরক্ষামূলক ধাপ। এমতাবস্থায় সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম শরীরে অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডকে উদ্দীপিত করে যা অ্যাডেরেনালিন হরমোন নিঃসরণ করে। এর ফলে হৃদপিন্ড দ্রুত রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে,জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে যাতে করে আরো বেশি অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করতে পারে, পেশী শক্ত হয়ে ওঠে যাতে করে “ফ্লাইট কিংবা ফাইট” প্রতিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব হয়ে থাকে। আবার অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের অন্য একটি শাখা, “প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম” কিছু সংখ্যক অঙ্গের কার্যক্রমের হ্রাস ঘটায় এবং কিছু অঙ্গের কার্যক্রম বৃদ্ধি করে যাতে করে শারীরিকভাবে নিরাময় সম্ভব হয়। নার্ভাস সিস্টেমের এ অংশটি হৃদপিন্ডের কাজের গতি কিছুটা হ্রাস করে, রক্তনালীগুলো প্রসারিত করে এবং মুখের লালা নিঃস্বরণ ত্বরান্বিত করে।

এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের কাজ
স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপটি হলো এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের কাজ। এ সিস্টেমটি অসংখ্য গ্ল্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত যা বিভিন্ন ধরনের হরমোন রক্তনালীতে নিঃসরণ করে থাকে। পিটুইটারী এবং অ্যাডরেনাল-দুটি গ্ল্যান্ড যা স্ট্রেস প্রতিক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। যখন হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করে তখন এটি এ.সি.টি.এইচ নামক হরমোন নিঃসরণ করে থাকে। এই হরমোনটি অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করে যা স্ট্রেস হরমোন ‘কর্টিসোল’ উৎপাদন করে। কর্টিসোল নার্ভাস সিস্টেমের ইমারজেন্সি ব্রাঞ্চকে সচল রাখে এবং স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

স্ট্রেস আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করে থাকে। দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেসের অবস্থা ব্যক্তির সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থার ব্যাঘাত ঘটায়। স্ট্রেস একই সাথে শারিরীক ও মানসিক স্বস্থ্যের অবনতি ঘটায়। এটি সঠিক চান্তন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়,স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে এবং জীবনকে উপভোগ করতে বাঁধা দেয়। এসকল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে সঠিক স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট অনেক বেশি জরুরি। এটি স্বাস্থ্যকর,সুখী জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয়।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য কতগুলো সংগঠিত পদক্ষেপ নেয়া যায়:

১. স্ট্রেসের কারণগুলো চিহ্নিত করা:
স্ট্রেস সৃষ্টিকারী কারণগুলো চিন্হিত করার মাধ্যমে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। কিন্তু এই কারণসমূহ চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যক্তিকে কতগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হয়, যেমন: কোন কারণসমূহ স্ট্রেস সৃষ্টি করছে, এর ফলে শারিরীক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে,স্ট্রেসের কারণে ব্যক্তির সার্বিক প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে এবং ব্যক্তি ভালো থাকার জন্য কি পদক্ষেপ নিচ্ছে ইত্যাদি। এসকল প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিকে স্ট্রেসের কারণসমূহ এবং তার সাথে মোকাবেলা করার জন্য গৃহীত পথগুলো সম্পর্কে জানা যায়।

২. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের ৪টি ‘A’ অনুশীলন করা:
যেহেতু স্ট্রেস নার্ভাস সিস্টেমের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া, সুতরাং যে কোন সময়, যে কোন ঘটনায় স্ট্রেসের উদ্রেক হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্ট্রেসের কারণগুলোর প্রতি ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য চারটি ‘A’ অনুশীলন করা জরুরি। এই চারটি ‘A’ হলো:

Avoid (এড়িয়ে চলা) Alter (পরিবর্তন করা) Adapt (খাপ খাওয়ানো) Accept (স্বীকার করে নেয়া)

Avoid (এড়িয়ে চলা) :
স্ট্রেস তৈরি করে এমন ঘটনা গুলো এড়িয়ে চললে স্ট্রেস কমানো সম্ভব। এছাড়া কোন ব্যক্তি, পরিবেশ যদি টেনশন বা স্ট্রেসের উদ্রেক করে থাকে তবে তাদের এড়িয়ে চললেও স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিজের প্র্যাতাহিক কাজগুলোর একটি রুটিন তৈরি করে নিলে তা সুবিধাজনক হয়। প্রয়োজনে কাজের চাপ কমাতে কিছু কাজ কমিয়ে নেয়া যেতে পারে।

Alter (পরিবর্তন করা):
যদি কোন ঘটনা, পরিস্থিতি বা ব্যক্তি আপনার বিরক্তি কারণ হয় তবে সে বিষয়ে সম্পাদনের সাথে দৃঢ়ভাবে তা প্রকাশ করা জরুরি। সকল কাজের একট ব্যালেন্সড শিডিউল তৈরি করা জরুরি।

Adapt (খাপ খাওয়ানো) :
যদি স্ট্রেস সম্পন্ন পরিস্থিতির বদলানো সম্ভব না হয়, তবে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার মাধ্যমে আশেপাশের পরিস্থিতিকে আরো স্বাভাবিকভাবে নেয়া যায়। এছাড়াও কোন কাজ পারফেক্টভাবে করার তীব্র ইচ্ছা ত্যাগ করার মাধ্যমে এবং নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমেও এ আচরণটি অনুশীল করা যায়।

Accept (স্বীকার করে নেয়া)
কিছু সংখ্যক স্ট্রেস সহজে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্র কোন ব্যক্তি, পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার মাধ্যমেই স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যে কোন বিষয় যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, সেটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করাটাই ভালো। জীবনে কঠিন চ্যালেন্জসমূহ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে পজিটিভ থাকাটা জরুরি। অন্যকে ক্ষমা করতে শেখা এবং বিশ্বস্ত কারো সাথে নিজের অনুভূতি শেয়ার করার মাধ্যমেও স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

৩. ব্যায়াম করা, গান শোনা, বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, বিভিন্ন ধরনের গেমস খেলা ইত্যাদি।
৪. অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা।  সরাসরি কারো সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে স্ট্রেস অনেকটা উপশমিত হয় যা ফ্লাইট অথবা ফাইট প্রতিক্রিয়াকে তরান্বিত করে।
৫. নিজের রিল্যাক্সেশনের জন্য, বিনোদনের জন্য সময় খুঁজে বের করা এবং জীবনকে উপভোগ করা।
৬. নিজের কাজের সময়কে সঠিকভাবে রুটিনমাফিক ব্যালেন্স করা।
৭. নিজের খাদ্যাভাসে পুষ্টিসম্মত খাবার রাখা, চা-কফি কম পান করা, নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি, ধূমপান না করা। সেই সাথে পরিমিত পরিমাণ ঘুম অনেক বেশি জরুরি।

অামাদের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা স্ট্রেসের সম্মুখীন হয়ে থাকি। অথচ তা যদি আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত কে তবে তা সুস্থ সুন্দর জীবনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তবে একজন অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্টের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন করা যায়।

লিখেছেন – সাদিয়া সানজিদা অধরা

 

ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব

Share

কোন ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিত, জোরপূর্বক তার সাথে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়াই ধর্ষণ। ধর্ষণের পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণ খুজতে গেলে, প্রথমেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানর মতো আসে যৌন অবদমন এর কথা। অর্থাৎ, ধর্ষণের ব্যাপারে সহজ থিওরি হলো ধর্ষক বিভিন্ন সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কারনে তার কাম-বাসনা মেটাতে পারে না, ফলে তার মাঝে অপরিতৃপ্ত যৌনাকাঙ্ক্ষা পুঞ্জিভূত হতে হতে একসময় কোন অসতর্ক নারীর উপস্থিতিতে ধর্ষণের মতো ভয়ানক অপরাধ রুপে বের হএ আসে। ধর্ষণের এই তত্ত্ব যতটা সহজ ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর, কেননা এই তত্ত্ব ভিকটিম শেমিং এর সুযোগ তৈরি করে দেয়। ব্যাপারটা এমন যেন নারী যদি সঠিক পোশাক না পরে, সঠিক আচরন না করে তবে তা একজন ধর্ষকে প্রলুব্ধ করে, এবং ধর্ষণ করার সময়ে ধর্ষকের দোষ থাকে না কারণ তার যৌনতা অবদমিত! ধর্ষণ না করে তার যেন উপায়ই ছিল না। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত “তেঁতুল ঝুলালে লোল পরবেই” বা “খোলা মিষ্টিতে মাছি বসবেই” এমন কথাবার্তার যথার্ততা দেয় এই তত্ত্ব।

ধর্ষণের এই ধারনা বহু প্রাচীন। এমনকি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ফ্রয়েডিও ঘরানার মনোবিজ্ঞানীদের কাছেও এটি জনপ্রিয় ছিল। তারা কেবলমাত্রও এটাই ভাবেন নি যে ধর্ষিতারাই ধর্ষণে প্রলুব্ধ করে, তারা আর বলেন সকল নারী অবচেতন ভাবে ধর্ষিত হতে চান!

তবে এই ধারনায় বড় রকমের আঘাত আসে  নারীবাদী সুজান ব্রাউনমিলারের বই “এগেন্সট আওয়ার উইল” (১৯৭৫) প্রকাশিত হবার পর। এই বইতে তিনি বলেন ধর্ষণ হল একটি সচেতন প্রচেষ্টা যার মাধ্যমে সকল পুরুষ সকল নারীকে একটি আতঙ্কিত অবস্থার মাঝে রাখে। ব্রাউনমিলার এই ধারনা কে চ্যালেঞ্জ করেন যে ধর্ষণ হল অবদমিত যৌন আকাঙ্খার ফসল, পরিবর্তে তিনি বলেন ধর্ষণ লিঙ্গ রাজনীতির ফসল।ধর্ষণের পেছনের প্রেষণা যৌনতা নয়, ক্ষমতার বিস্তার। নারীর ওপর পুরুষের ক্ষমতার বিস্তার। এবং বর্ণবাদের মতই লিঙ্গবাদকে প্রতিরোধ করতে পারলে,ধর্ষণের প্রতিকার আসবে।

 

ধর্ষণে যদি কেবলমাত্র যৌন আকাঙ্খাই দায়ী থাকে, তবে তো শুধু নারীরাই ধর্ষণের শিকার হতেন। কিন্তু বাস্তবে তো দেখা যাচ্ছে নারীদের পাশাপাশি শিশু এবং বয়স্ক নারীরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, যাকে কোনভাবেই যৌন আকাঙ্খা দিয়ে ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়।

পরবর্তীতে বেশ কিছু গবেষণায় ধর্ষণের নারীবাদী ধারনার সত্যতা পাওয়া যায়।তার মাঝে সর্বপ্রথম ও সবচে প্রভাবশালী গবেষণা করেন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস গ্রথ। ১৯৭৯ সালে তার প্রকাশিত “মেন হু রেইপ” এ তিনি দেখান যে সকল ধর্ষকের তিনটি মোটিভ থাকতে পারে, ধর্ষকাম( স্যাডিজম), ক্রোধ এবং খমতা।তিনি বলেন ধর্ষণ কোনভাবে সুস্থ মস্তিস্কের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কোন স্থায়ী অথবা সাময়িক মনবিকারগ্রস্থ মানুষের পক্ষেই সম্ভব।তিনি আরও দেখান যে ধর্ষণ একটি যৌনক্রিয়ার আড়ালে ক্ষমতা এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। তার গবেষণায় কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা থাকলেও ধর্ষণ নিয়ে তার গবেষণাকেই প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাজ বলে গণ্য করা হয় যেটি ধর্ষণকে যৌনতার বাইরের মোটিভ দিইয়ে দেখাতে চেয়েছেন।

 

 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ধর্ষকদের শরীরে টেস্টোস্টেরন এর মাত্রা সাধারনের থেকে বেশি নয়। এছাড়া যৌনসহবাস এর অভাবের সাথেও ধর্ষণের কোন সংগতি পাওয়া যায় নি। যেমন পল গেবহা্রড ও তার সহকর্মীরা তাদের “সেক্স অফেন্ডার্সঃ এন এনালাইসিস অব টাইপস” (১৯৬৫) প্রকাশনায় দেখিয়েছেন বিবাহিত ধর্ষকরা তাদের স্ত্রীর সাথে সহবাসে সক্রিয় থাকেন। এই সমস্ত গবেষণা এটাই নিরদেশ করে যে কেবল যৌন অবদমনে পুঞ্জীভূত কামবাসনাই ধর্ষণের মূল কারণ নয়।

তবে কি ধর্ষণের মূল কারণ পাওয়া গেল যৌনতা নয় ক্ষমতাই এর পেছনে দায়ী? আসলে যেকোনো আচরণকে একটিমাত্র মাত্রা দিএ ব্যখ্যা করা কঠিন। পাশাপাশি ক্ষুধা তৃষ্ণার মতো যৌনতা একটি সহজাত প্রবৃতি ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় রিচার্ড ফেলসন ও তার কলিগ প্যট্রিক কানডিফ, এফ বি আই থেকে নেয়া ৩০০০০০ ধর্ষণের নথি পর্যালোচনা করে দেখেন যে একজন ধর্ষিতার বয়স গড়ে ১৫ বছর। এর আগেও রিচার্ড ফেলসন ও রিচার্ড মোরান পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখান যে অধিকাংশ ধর্ষিতাই তরুণী। সায়েন্টিফিক লিটারেচারে তারুন্য , যৌন আকর্ষণের সাথে সম্পর্কিত। এটা বলা যেতে পারে যে ধর্ষকরা তরুণীদের আক্রমন করছে কারণ তাদের টার্গেট করা সহজ। তবে বয়স্কা নারী এবং শিশুরাও তুলনামূলক সহজ টার্গেট, কিন্তু পরিসংখ্যান হিসেবে তাদের আক্রান্ত হবার হার তরুণীদের তুলনায় কম। বলা যায় ধর্ষণের মূল ভিক্টিম হচ্ছে তরুণরা কেননা তারা যৌন আবেদনময়ী এবং ধর্ষণের পেছনে রয়েছে ধর্ষকদের যৌনমিলনের ইচ্ছা।

এছাড়া কিছু ল্যাবরেটরি গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে ধর্ষকদের যৌন উত্তেজনার প্যাটার্ন ভিন্ন রকম। তারা অস্মমতিতে করা যৌনক্রিয়ার কথা শুনলে তাদের তীব্র লৈঙ্গিক প্রতিক্রিয়া হয়।এবং ২০১২ সালে কানাডীয় গবেষক গ্রান্ট হ্যারিস ও তার সহকর্মীরা গবেষণায় পান যে যৌনক্রিয়া বিহীন আগ্রাসন ও জখমের ক্ষেত্রে ধর্ষকদের লৈঙ্গিক প্রতিক্রিয়া খুব একটা হয় না।

 

অর্থাৎ, সম্মতি বিহীন যৌনক্রিয়ায় ধর্ষকরা যে আনন্দ পায়, যৌনক্রিয়া বিহীন আগ্রাসনে সেরকম আনন্দ তার পায় না। সুতরাং পূর্বের ও পরের গবেষণার আলোকে বলা যায় ধর্ষণকে একইসাথে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং যৌনাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থের উপায় হিসেবে ধর্ষকরা বেছে নেয়। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেভারলি ম্যাকফিল ধর্ষণের মোটিভের ওপর বিভিন্ন নারীবাদী তত্ত্ব একত্রিত করে ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের একটি মডেল দাড়া করান। তিনি বলেন ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক ও আগ্রাসী আচরন যার মাধ্যমে পুরুষেরা দলবদ্ধভাবে নারীদের ওপর আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং ের পেছনের মোটিভ একটি নয় বরং অনেকগুলো, যেমন যৌনপরিতৃপ্তি ,প্রতিশোধ, মনোরঞ্জন, ক্ষমতা/আধিপত্য এবং পৌরুষ্য প্রদর্শনের মনোভাব।

 

সুত্রঃ

Why men rape – Sandra Newman

Rape is Not (Only) About Power; It’s (Also) About Sex

লেখকঃ মিশাদ 

হোপ অটিজম সেন্টার

Share

হোপ অটিজম সেন্টার – অটিস্টিক শিশুদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য একটি আশার আলো।

ঢাকার কলাবাগানে অবস্থিত এই জন্য একটি দাতব্য সংস্থাটি  অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (Autistic Spectrum Disorder) এবং অন্যান্য মেধাবিকাশ জনিত সমস্যার সম্মুখীন শিশুদের জন্য বিভিন্ন সেবা প্রদান করে, যা তাদের স্পিচ, সামাজিক ইন্টারেকশন  উন্নত করতে এবং একাডেমিক দক্ষতা বিকাশের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাহায্য করবে।

হোপ অটিজম সেন্টার এর  প্রতিষ্ঠাতা ডঃ নুসরাত আহমেদ ইটস ওকে বাংলাদেশকে বলেন, “হোপ অটিজম সেন্টার এ, আমরা আমাদের  শিক্ষার্থীদেরকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিভিন্ন দ্বন্দের সম্মুখীন হয়ে তাকে জয় করতে তৈরি করি। আমরা প্রতিদিন তাদের ডেটা সংগ্রহ করি, যাতে প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা করে তার প্রয়োজন এর উপর ভিক্তি করে ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারি। “
কেন্দ্রটি তাদের শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজ করা, সবার সাথে মেলামেশাসহ আরো অন্য সব কাজ শেখায়, যা শিশুর মানসিক বিকাশে সাহায্য করে। একটি শিক্ষার্থী যখন প্রচলিত স্কুলে যায়, তখন তারা যাতে সহজেই পড়াশোনা আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, এই দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা হয়।  “আমাদের একজন ছাত্র সম্প্রতি ক্লাস ৬ এ উঠেছে!” খুবই উৎসাহের সাথে বললেন ডঃ নুসরাত। যদিও এইসব ক্ষেত্রে বাচ্চাদের প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। “কখনও কখনও তারা হতাশ হয়ে পড়ে, এমনকি ডিপ্রেশন এও পড়ে যেতে পারে, হয়ত কোন সহপাঠী তাদের নিয়ে মজা করল বা পড়া বুঝতে পারল না। আমরা এই ধরনের কেইসে বিশেষ যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করি এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করি।”
বাস্তবে আসলে আমাদের অধিকাংশ নিয়মিত স্কুলই অটিস্টিক শিক্ষার্থীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। যার ধারাক্রমে স্কুলের বা প্রতিষ্ঠানের অনান্য বাচ্চারাও তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে নিতে বা মিশতে শেখে না।
হোপ অটিজম সেন্টারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা হচ্ছে তাদের  আন্তর্জাতিক মানের প্রাথমিক হস্তক্ষেপ (Early intervention ) সেবা। “প্রথম দিকে হস্তক্ষেপ এমন শিশুদের সাহায্য করার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। দুই বছর বয়সের আগে প্রাথমিক হস্তক্ষেপ আর ডায়াগনোসিস এই সব কেইসে  উন্নয়নের জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ দেয়।” কেন্দ্রটি বাংলাদেশের একমাত্র সংস্থা যেখানে অটিস্টিক শিশুদের জন্য প্রাথমিক সাপোর্টেড ডিসিশন মেকিং (Supported Decision Making ) অনুশীলন করার জন্য কাজ করা হয়।
হোপ অটিজম সেন্টারে অটিজম সংক্রান্ত আরো যা যা সেবা প্রদান করা হয়ঃ
ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস:
– আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত ডায়গনিস্টিক মানদণ্ড নিম্নলিখিত ডায়াগনস্টিক মূল্যায়ন
– সম্পর্কিত মেডিকেল শর্তাবলী জন্য মেডিকেল পরামর্শ
– চিকিত্সা প্রয়োগে সহায়তা করতে ফলো-আপ পরামর্শ
পরামর্শ সেবা:
– পারিবারিক পরামর্শ নির্দিষ্ট আচরণগত / একাডেমিক উদ্বেগ মোকাবেলা
– উপযুক্ত হোম ম্যানেজমেন্টের জন্য পরামর্শ
স্কুল প্রোগ্রাম:
– মৌলিক আলাপ-চারিতার দক্ষতা
– সামাজিক দক্ষতা
– প্রাক-একাডেমিক দক্ষতা
– দৈনিক জীবন কার্যক্রমের দক্ষতা
– পেশাগত থেরাপি
জনসংযোগ কর্মসূচি:
-প্রাথমিক মূল্যায়ন
– ঢাকা শহরের বাইরে থেকে শিশুদের ও পিতামাতার সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের সেশন (নির্দিষ্ট সময় এবং পরিবারের উপর নির্ভর করে)
– বাড়ীতে হস্তক্ষেপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাবা-মা’র ক্ষমতার বিকাশ
প্রশিক্ষণ:
– বাবা-মা এবং প্রশিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচী

শিক্ষা পরিষেবা:
– পিতা-মাতা ও প্রশিক্ষকগণের জন্য বাংলায় ম্যানুয়াল / লিফলেট প্রকাশ

গবেষণা:
– অটিজমের ওপর ফলিত গবেষণা: খাদ্যতালিকাগত এবং অন্যান্য জৈবরাসায়নিক হস্তক্ষেপ
– অটিজমের উপর সামাজিক গবেষণা

এডভোকেসি:
অটিজম সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি।

যোগাযোগ এবং আলাপ-চারিতার দক্ষতা:
হোপ অটিজম সেন্টারের নিজস্ব বক্তৃতা উন্নয়ন পদ্ধতি এর মাধ্যমে শিশুদের একটি উদ্দীপক পরিবেশে কোন বলপূর্বক ছাড়া তাদের  বক্তৃতা ক্ষমতার বিকাশে উত্সাহ দেওয়া হয়।
হোপ অটিজম সেন্টার সম্পর্কে আরও জানতে যোগাযোগ করুন:
ঠিকানাঃ
হোপ অটিজম সেন্টার
১৫২/২বি,
গ্রীনরোড, কলাবাগান,
ঢাকা – ১২০৫, বাংলাদেশ।
টেলিফোনঃ
বাংলাদেশ              01715527507
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র    1 503 550 9554
ডঃ নুসরাত আহমেদ 

নুসরাত আহমেদ একজন চিকিৎসক এবং অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি তার এমবিবিএস করেন ঢাকা মেডিকেল, বাংলাদেশ; ফ্লিন্ডারস ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ায় (Flinders University Australia) এমএমএইচএসসি (MMHSc) এবং যুক্তরাজ্য থেকে আন্তর্জাতিক অ্যাডোস ট্রেইনার সার্টিফিকেশন (International ADOS trainer certification)।

নুসরাত বর্তমানে সুচনা ফাউন্ডেশনের  গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। অস্ট্রেলিয়াতে কাজ করার সময় তিনি ল্যাত্রোব  বিশ্ববিদ্যালয়ের (Latrobe University) এএসডি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল এএসডি এবং / অথবা আইডি এবং পরামর্শের সাথে শিশুদের নির্ণয় করা এবং সেই অনুযায়ী পরিবারকে নির্দেশনা করা। মারডক চিলড্রেন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (Murdoch Childrens Research Institute), তিনি ফ্রাগাইল এক্স (Fragile X) সিন্ড্রোমের সাথে কাজ করেন। তিনি পরিবার এবং পেশাদারদের জন্য বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন এবং বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, তাজিকিস্তান, ভারত, কানাডা এবং ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ডঃ নুসরাত হোপ অটিজম সেন্টার, বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, যা এএসডি সহ ব্যক্তিদের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা।

ডঃ নুসরাত নিম্নলিখিত নিবন্ধের লেখক: আহমেদ, এন, ও লন, এস। (২০১২)। জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি (CBT) এর আচরণগত কম্পোনেন্টের সাথে শুরু কি থেরাপি রোগীদের রক্ষণ বৃদ্ধি? আচরণ পরিবর্তন, ২৯(৪), ২৩৮-২৫৭

মন খারাপ জয়ের গল্প

Share

খুব সকালে যখন ঘুম ভাঙে পূর্ণ‘র ,তখন কিছুতেই ওর উঠতে মন চায় না, তবুও মনে মনে ভাবে কেউ যদি একটু আদর করে ঘুম ভাঙাতো …ঠিক এমন সময়ই মা গলা খাকরানি দিয়ে বলে উঠেন, ”আর কতোক্ষণ…… আমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে , নাস্তা রইল টেবিলে, খেয়ে নিয়ো“। পূর্ণ কিছুদিন হয় স্কুলে যেতে পারছে না… ওর খুব মাথা ব্যাথা , প্রায়ই শ্বাসকষ্ট হয়,মাঝে মাঝেই সারা শরীরে খিঁচুনি দিয়ে ওঠে ,স্কুলে গেলে আরও বাড়ে কিন্তু বাসায় থাকলে কি কমে ? কই বাসায় থাকলেও তো হয় … ওহহো কথায় কথায় বলাই হয় নি পূর্ণ‘র বয়স ৯, ওরা তিন ভাইবোন , বড় বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাইটি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র । ভাইবোনদের সাথে বয়সের যেমন তফাতটা বেশি ঠিক তেমনি মনের দূরত্বটাও কম যায় না । কেউ যেন ওকে বুঝতে চায় না আর মা-বাবা তো বলতেই না । স্কুলে যখন যেতো , ও আর যাইহোক অবহেলা ব্যাপারটা কোনমতেই মেনে নিতে পারতো না, কেউ বকলে বা বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো কিন্তু পূর্ণ স্কুলে যেতে চায় , বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে চায়,সবার অনেক আদর চায় আর চায় একটু সময় , খুব কি বেশি চেয়ে ফেলেছে সে ?
কিন্তু বাস্তবটা ভিন্ন কারণ উপরের অনেককিছুই পূর্ণ‘র নিজস্ব চিন্তা যার আদতেও কোন ভিত্তি নেই। যেমন পূর্ণ‘র মা-বাবা চাকুরীজীবী হলেও তাকে অনেকটা সময় দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু মুশকিল হল যতক্ষণ কাছে থাকে ততোক্ষণ এটা করো না, ওটা ধরো না , বেশি বেশি পড় ,এইসব বলতে থাকে কিন্তু বেশি পরা-লেখা কেন করা দরকার তা বলেন না ,তাই সে তেমন উৎসাহও বোধ করে না ,ভাইবোনদের সাথে থাকলেও ওর সময়টা এমনই কাটে ।
পূর্ণ আসলে একজন কনভার্সন ডিসঅর্ডারের রোগী। এই রোগে মনের মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্ব এবং চাপ শারীরিক সমস্যায় রুপ নেয়। মনোচিকিৎসক তার রোগটি শনাক্ত করার পর কিছু ঔষধ দেন এবং একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছ থেকে সাইকোথেরাপি গ্রহণের জন্য পাঠান । নিয়মিত মনের জমে থাকা কষ্টের কথাগুলো মনোবিজ্ঞানীকে খুলে বলাতে সে কিছুটা হাল্কা বোধ করতে থাকে আর পাশাপাশি তার পরিবারকে একজন ৯ বছরের আবেগি শিশুর সাথে কেমন ব্যাবহার করা উচিত তা সেখানো শুরু করেন মনোবিদ এবং পূর্ণ ও পরিবার উভয়কে সাথে নিয়ে বসে তাদের মধ্যকার ভুলবোঝাবুঝিগুলো দূর করে সম্পর্কের মান উন্নয়নের চেষ্টা করেন , সেইসাথে পারিপার্শ্বিক সমাজে চলাফেরা করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার অভ্যাস করা এবং কিছু কৌশল সেখানো হয় । সাইকথেরাপির নিয়মিত সেশন গ্রহণ এবং সেবনে পূর্ণ দ্রুতই শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
পূর্ণ এখন ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল । সে প্রায় প্রতি সপ্তাহে বন্ধের দিনগুলোতে পরিবারের সবার সাথে ঘুরতে বের হয় আর ভাইবোনদের সাথেতো বাসায় থাকলে সারাক্ষণই খুনসুটি করা হয় ,ওদের বাড়িটা যেন এখন সবসময় হৈ-হুল্লরে মুখর হয়ে থাকে। ওর কিছু ভালো বন্ধুও তৈরি হয়েছে তাছাড়া ক্লাসের সবার সাথেই ওর অনেক ভাব। টিচারও ওকে অনেক ভালোবাসে। পূর্ণ জয় করে ফেলেছে ওর মনের সব ভয় ।

কনভার্সন ডিসঅর্ডার সম্পর্ক এ আরও জানতে পড়ুন :

https://rx71.co/disease/conversion-disorder/

লেখক:

  1. জেসমিন মাহমুদা জুথি

ভাল্লাগেনা জেনারেশন – কেন আমাদের কোন কিছুই ভালো লাগে না?

Share

illustration by Ahnaf Sahriar showing our unhappy generation

খানিক পর পর ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করছে মাঈশা। ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ব্রেকাপ পার্টিতে এসেছে সে। নিজের আইফোনে এই মাত্র একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করলো মাঈশা। এক মিনিট পেরিয়ে গেলেও কোনো লাইক আসে নি। দুই মিনিট পর সে আবার চেক করলো— মোটে পাঁচটা লাইক! বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে এলো তার। ধুর, কিচ্ছু ভাল্লাগে না!

মাঈশা বাংলাদেশের বিলাসপ্রিয় জেনারেশনের অংশ— তাদের জন্ম মূলত আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশক জুড়ে। এই জেনারেশনের একটা বড়ো অংশ শহুরে সুবিধাভোগী উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিলাসপ্রিয় তরুণ সমাজ, যাদের ধারণা তারা একটা বিশেষ গল্পের প্রধান নায়ক বা নায়িকা। মাঈশা তাদেরই একজন। বোঝার সুবিধার্থে এই বিলাসপ্রিয় জেনারেশনের একটা নাম দেয়া যাক: ভাল্লাগেনা জেনারেশন।

মাঈশা নিজের ভাল্লাগেনা জীবন বেশ ভালোই উপভোগ করছে। সমস্যা শুধু একটাই: তার কিছুই ভালো লাগে না। সে রীতিমতো অসুখি। কারণ জানতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে। বুঝতে হবে ঠিক কী কারণে একজন মানুষ সুখি কিংবা অসুখি হয়। ইকুয়েশনটা এরকম:

happiness equals to reality minus expectations

আর যখন একটা মানুষের রিয়েলিটি তার এক্সপেক্টেশনের সঙ্গে মিলে না, তখন সে অসুখি হয়। মাঈশার রিয়েলিটি তার এক্সপেক্টেশনের সঙ্গে মিলে নাই। কেনো মিলে নাই? সেটা বুঝার জন্যে মাঈশার বাবা-মায়ের অবস্থাটাও বুঝা জরুরী।

মাঈশার বাবা-মা!

মাঈশার বাবা-মা মাঈশার বাবা-মা জন্মেছেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। তাদের বড়ো করেছেন মাঈশার দাদা-দাদু, নানা-নানু— যারা গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়টায় বড়ো হয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। অবশ্যই তারা ভাল্লাগেনা জেনারেশনের অংশ না।

মন্দা ও যুদ্ধের ভয়াবহতায় জর্জরিত মাঈশার দাদা-দাদুর মূল ভাবনা ছিলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কেন্দ্রিক। তারা মাঈশার বাবা-মাকে বেশ রিয়েলিস্টিক করে বড়ো করেছেন যেন তারা সবার আগে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে মনোযোগী হয়। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’— নিজের ছেলেমেয়েদের জন্যে এমনটাই চাইতো মাঈশার দাদা-দাদু। আরও চাইতো তাদের ছেলেমেয়েদের লাইফস্টাইল তাদের চেয়ে উন্নত হোক। তাদের বাগান জুড়ে থাকুক প্রাণবন্ত সবুজ ঘাস।

সমৃদ্ধ ও স্থায়ী ক্যারিয়ারের স্বপ্ন দেখতে দেখতে মাঈশার বাবা-মা বড়ো হলো। তারা জানতো, তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব না। তবে, তার জন্যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে গড়তে হবে সফল ক্যারিয়ার।

মাঈশার বাবা-মায়ের এক্সপেক্টেশন

প্রথাবিরোধী মনোভাব নিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর মাঈশার বাবা-মা তাদের ক্যারিয়ারের দিকে মন দিলো। এদিকে সত্তর-আশি-নব্বই দশক পেরিয়ে যেতে থাকলে পৃথিবীর অর্থনীতি অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির মুখ দেখলো। মাঈশার বাবা-মা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে উন্নত জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ও আশাবাদী ছিলো।

মাঈশার বাবা-মায়ের রিয়েলিটি

নিজেদের বাবা-মায়ের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ও নিশ্চিন্ত জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মাঈশার বাবা-মা মাঈশাকে বড়ো করলো ভীষণ আশাবাদ ও অমিত সম্ভাবনায়। শুধু তারা না, তাদের জেনারেশনের প্রায় সব বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের এমন ভাবে বড়ো করেছে যেন তারা যা চাইবে তাই পাবে। এই শুনতে শুনতে ভাল্লাগেনা জেনারেশন নিজেদের বিশেষ কেউ ভাবতে শুরু করে, যেন পুরো পৃথিবী তাদের কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাদের মনে গেঁথে গেছে তারা একটা বিশেষ গল্পের প্রধান চরিত্র। নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে তারা অস্বাভাবিক রকম বেশি আশাবাদী হয়ে ওঠে। এতোটাই বেশি যে তাদের বাবা-মায়ের সমৃদ্ধ ও স্থায়ী ক্যারিয়ারের স্বপ্ন তাদের কাছে পুরনো ধ্যান ধারণা ঠেকতে শুরু করে। তাদের নিজস্ব বাগানে শুধু সবুজ ঘাস থাকলেই হবে না, বাগান জুড়ে অসংখ্য রঙিন ফুল থাকা চাই!

তো ভাল্লাগেনা জেনারেশন সম্পর্কে আমরা যা ধারণা পেলাম, তা অনেকটা এরকম: ভাল্লাগেনা জেনারেশন অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

ভাল্লাগেনা জেনারেশনের আকাশ কুসুম কল্পনা

তাদের বাবা-মায়ের নিরাপদ সমৃদ্ধ জীবনের চেয়ে তাদের আরও বেশি কিছু চাই। তাদের বাবা-মায়েরা যেমন একটা সিকিউর লাইফস্টাইল হলেই সন্তুষ্ট থাকতো, তাদের ক্ষেত্রে সেটা হলো না। তারা নিজেদের স্বপ্নের জগতে বসবাস করতে চায়— তাদের পার্সোনাল ড্রিম লাইফ! তাদের জীবনের মূলমন্ত্র একটাই, ‘Follow your passion’, গত বিশ বছর ধরে এটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জনপ্রিয় একটা লাইন। ‘Secure Career’ তাদের জন্যে যথেষ্ট নয়, তাদের দরকার ‘Fulfilling Career’.

বাবা-মায়ের মতো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তাদের চাই, কিন্তু সেই সাথে নিজেদের ক্যারিয়ার থেকে তাদের পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি চাই, যেটা নিয়ে তাদের বাবা-মায়ের কোনো মাথা ব্যথাই ছিলো না। গল্পটা এখানেই শেষ না, আরও অনেক কিছু বাকি। উচ্চাভিলাষী মাঈশাকে ছোটো বেলায় বিভ্রান্তিকর আরও অনেক কিছু বলা হয়েছে। জন্মের পর থেকে সবাই তাকে বলেছে, ‘তুমি স্পেশাল।’

ভাল্লাগেনা জেনারেশন বসবাস করে অদ্ভুত বিভ্রান্তির ভেতর। মাঈশা মনে করে, “সবাই নিজেদের জন্যে একটা ফুলফিলিং ক্যারিয়ার বেছে নিবে ঠিকই, কিন্তু আমি সবার চেয়ে আলাদা, অসাধারণ। তাই আমার ক্যারিয়ার ও লাইফস্টাইল হবে সবার চেয়ে অন্যরকম।” গোটা একটা জেনারেশন এরকম এক অদ্ভুত বিভ্রান্তি নিয়ে মনে করতে থাকে তারা অন্যদের চেয়ে সৌভাগ্যবান, তাই তারা অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। তাদের ফুলেল বাগানে থাকবে রঙিন পঙ্খিরাজ ঘোড়া।

আপনি ভাবছেন, তো এতে বিভ্রান্তির কী আছে?

একটা জেনারেশনের সবাই নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা আর স্পেশাল ভাবতে থাকলে, সেটা বিভ্রান্তি ছাড়া আর কী! স্পেশাল, অনন্য, অতুলনীয়, অসাধারণ— কিন্তু সবাই যদি অসাধারণ হয়, তাহলে অসাধারণ কথাটার মানে কী থাকলো!

এই মুহূর্তে ভাল্লাগেনা জেনারেশন এই লেখাটা পড়তে পড়তে ভাবছে, “একদম ঠিক! কিন্তু আমি সত্যিই অসাধারণ!” সমস্যাটা এখানেই।

চাকরির বাজারে প্রবেশ করার পর, ভাল্লাগেনা জেনারেশনের বিভ্রান্তি আরও বাড়তে থাকে। মাঈশার বাবা-মা মনে করতো অনেক বছর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে সিকিউর ক্যারিয়ার গড়তে হবে। কিন্তু ‘অসাধারণ’ মাঈশা মনে করে আলাদিনের জাদুর চেরাগ ঘষে অসাধারণ ক্যারিয়ার চাইলেই, দৈত্য এসে তার ইচ্ছে পূরণ করে দেবে। যথাসময়ে একটা তুড়ি বাজালেই কাজ হয়ে যাবে!

মজার ব্যাপার হলো, দুনিয়াটা এতো সহজ জায়গা না। দারুণ একটা ক্যারিয়ার গড়তে রীতিমতো সাধনা করা লাগে। রক্ত পানি করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে হয়, তারপরও সেখানে পঙ্খিরাজ দূরে থাক, ফুলের দেখা নাও মিলতে পারে। কোনো সফল মানুষের জীবনে সাফল্য এমনি এমনি আসে না।

কিন্তু ভাল্লাগেনা জেনারেশন এই সত্য মেনে নিতে প্রস্তুত না।

ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ারের একজন প্রফেসর এবং ‘ভাল্লাগেনা জেনারেশন’ এক্সপার্ট পল হার্ভি বলেন, “এই জেনারেশনের এক্সপেক্টেশন বিভ্রান্তিকর অবাস্তব, কোনো রকম নেগেটিভ ফিডব্যাক সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নাই। নিজেদের নিয়ে আকাশ কুসুম কল্পনায় অভ্যস্ত তারা। যোগ্যতার বড়াই ও অতিরিক্ত প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতা না মিললে তারা হতাশার অন্ধকারে ডুবে যায়। নিজেদের সামর্থ্য ও যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি সম্মান, পারিশ্রমিক ও মনোযোগ আশা করে তারা, বিনিময়ে কঠোর পরিশ্রম করার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। তাই এক্সপেক্টেশনের সঙ্গে তাদের রিয়েলিটি কখনোই মিলে না।”

হার্ভি মনে করেন, ভাল্লাগেনা জেনারেশনকে চাকরির ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করা উচিত, “তুমি কি তোমার ক্লাসমেট ও কলিগদের চেয়ে নিজেকে সুপিরিয়র মনে করো? কেনো মনে করো?” তিনি বলেন, প্রথম প্রশ্নের উত্তরে ক্যান্ডিডেট যদি হ্যাঁবোধক উত্তর দেয়, কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলার মতো কিছু খুঁজে না পায়, তাহলে বুঝতে হবে সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে সে। ছোটো বেলা থেকে নিজেকে অসাধারণ বলে বিশ্বাস করে এসেছে বলে অতিরিক্ত আত্মসম্মান বোধে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। নিজেকে অসাধারণ মনে করার পেছনে কোনো কারণ না থাকলেও এই নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করলে আঁতে ঘা লাগে তার।

কিন্তু বাস্তব দুনিয়া অন্যরকম, যোগ্যতার মাপকাঠি এখানে মেধা। তাই গ্র্যাজুয়েশনের পর অতল গহ্বরে পড়ে মাঈশা। কারণ তার এক্সপেক্টেশনের সঙ্গে রিয়েলিটি একেবারেই মিলছে না।

উদ্ধত, উচ্চাভিলাষী, বিভ্রান্তিকর মাঈশা ইউনিভার্সিটি পাশ করে বাইরের দুনিয়ায় পা রাখতেই দেখতে পায় তার এক্সপেক্টেশন-রিয়েলিটি ইকুয়েশনের রেজাল্ট নেগেটিভ।

না, এখানেই শেষ নয়। অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করে। ভাল্লাগেনা জেনারেশনের আরও গভীর একটা সমস্যা আছে।

ভাল্লাগেনা জেনারেশন নিজেদের সমালোচনা ও উপহাস শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে।

মাঈশার বাবা-মা তাদের ক্লাসমেটদের সাফল্য কিছুটা শুনে টুনে থাকলেও, সেভাবে দেখে নাই। সেটা নিয়ে তারা অতো মাথাও ঘামায় নাই। কিন্তু মাঈশার ঘটনা আলাদা— কারণ সোশ্যাল মিডিয়া। প্রতি মুহূর্তে মাঈশার ইগো আহত করার জন্যে আছে ফেসবুকের রঙিনতম দুনিয়া।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মাঈশা প্রতি মুহূর্তে জানতে পারছে, কে কী করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিটা মানুষ তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করে। যারা স্ট্রাগল করছে তারা তাদের বাস্তবতা লুকিয়ে রাখে। অন্যদিকে যারা তাদের ক্যারিয়ারে কিছুটা হলেও সফল, তারা সেটা ঢাক ঢোল বাজিয়ে প্রচার করছে। শুধু ক্যারিয়ার না, রিলেশনশিপের ব্যাপারেও তা সত্যি। ফেসবুক জুড়ে সুখ-সুখ ভাব, সাফল্যের প্রচার, অনেক ভালো থাকার ভান দেখে মাঈশার দুর্দশা আরও বাড়ে।

আগে সে অসুখি ছিলো, এখন রীতিমতো ডিপ্রেসড, ফ্রাস্ট্রেটেড। নিজের সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সের সাথে রিয়েলিটি না মিললে মাঈশা ইনফেরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে ভুগতে শুরু করে। এই অবস্থায় মোটামুটি ভালো একটা কিছু করতে গেলেও সেটা নিয়ে তার ভেতরে অসন্তোষ থেকেই যায়।

মাঈশার উদ্দেশ্যে বলতে চাই:

উচ্চাকাঙ্ক্ষী থাকো। বর্তমান পৃথিবীটা উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের জন্যে ভালো জায়গা। ফুলফিলিং ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সুযোগ তুমি পাবে। কীভাবে? সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। পথটা তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। তবে তার জন্যে তোমাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। হাল ছাড়লে চলবে না।

নিজেকে অসাধারণ বা স্পেশাল কেউ ভাবা বন্ধ করো। সত্যি বলতে, তুমি স্পেশাল কেউ না। তুমি একজন অনভিজ্ঞ তরুণ। পৃথিবীকে এখনো তেমন কিছু দিতে পারো নি তুমি। তবে, তোমার পক্ষে স্পেশাল হয়ে ওঠা সম্ভব। অনেক বছরের কঠোর পরিশ্রম তোমাকে সত্যি সত্যি অসাধারণ মানুষ করে তুলবে।

নিজেকে ছাড়া বাদবাকি সবাইকে অগ্রাহ্য করো। অন্যের বাগানের ঘাস বেশি সবুজ মনে হওয়াটা নতুন কিছু না, কিন্তু এই ফটোশপের দুনিয়ায় অন্যের বাগান আরও সমৃদ্ধ, আরও উজ্জ্বল, আরও রঙিন মনে হয়। সত্যি বলতে, সবাই তোমার মতোই নিজেকে নিয়ে দ্বিধান্বিত, সন্দেহগ্রস্থ, নিরাশ ও খামখেয়ালি। তুমি যদি তোমার কাজটা ঠিকঠাক ভাবে করো, তাহলে অন্যদের হিংসা করার কোনো কারণ নাই।

মূল: Why Generation Y Yuppies Are Unhappy by Tim Urban

রূপান্তর: ফারাহ্‌ মাহমুদ

All creative arts are created by Ahnaf Shahriar