গত আর্টিকেলে আমরা জেনেছিলাম স্ট্রেস সম্পর্কে। স্ট্রেস হচ্ছে মানুষের অভ্যন্তরীণ এমন একটি ক্ষতিকারক অবস্থা যা কিনা শারীরিক চাহিদা কিংবা আশেপাশের পরিবেশ এবং সামাজিক পরিস্থিতির কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে। ব্যক্তি যদি স্ট্রেসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তবে সেটি ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রের জন্যই ক্ষতিকারক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে। স্ট্রেস কে নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা স্ট্রেসকে মানিয়ে চলার মাধ্যমে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেকটাই চাপমুক্ত থাকতে পারি। প্রতিটি মানুষই ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রতিনিয়ত স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সাধারণত স্ট্রেসকে মানিয়ে চলার বিভিন্ন পদ্ধতিকেই আমরা স্ট্রেস কোপিং স্ট্র্যাটেজি বলে জানি।
স্ট্রেস বা দৈনন্দিন জীবনের চাপ মানিয়ে চলার বিভিন্ন উপায় রয়েছে যেমন: স্ট্রেসযুক্ত ঘটনাটির মুখোমুখি হওয়া, চাপযুক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাধানের দায়িত্ব গ্রহণ করা, স্ট্রেসযুক্ত ঘটনা বা পরিস্থিতি কে এড়িয়ে চলা, সমস্যা সমাধানের কৌশল সম্পর্কে ভাবা এবং একই সাথে ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন চিন্তা করা।
o ব্যক্তি স্ট্রেসযুক্ত অবস্থা থেকে দূরে না সরে যেয়ে ঘটনাটির মুখোমুখি হয় এবং সেটিকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। স্ট্রেসযুক্ত সমস্যাটির সমাধান যখন ব্যক্তির একার পক্ষে করা সম্ভব না হয় কিংবা সামাজিক ভাবে একটি ভালো সমাধানের সম্ভাবনা থাকে তখন ব্যক্তি তার আশেপাশের মানুষের সাহায্য চায়। সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তি স্বভাবতই সামাজিক সমর্থন আশা করে থাকে। স্ট্রেসযুক্ত অবস্থায় সামাজিক সমর্থন ব্যক্তিকে নিজের উপর থেকে স্ট্রেসের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। আশেপাশের মানুষের এক্ষেত্রে সহায়তা, পরামর্শ বা নৈতিক সমর্থন প্রদান করতে পারে যা ব্যক্তিকে স্ট্রেসফুল সিচুয়েশন থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে।
o ব্যক্তি অনেকসময় নিজেই স্ট্রেসযুক্ত অবস্থার সমাধানে এগিয়ে আসে এবং নিজেই তা সমাধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
o অনেকেই রয়েছেন যারা স্ট্রেসযুক্ত অবস্থা থেকে অনেকটা পালিয়ে বাঁচতে চান। তাদের মধ্যে অনেকের মনে এই ধারণা জন্মায় যে স্ট্রেস উৎপন্ন করে এমন কাজকর্ম কিংবা চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে থাকলে স্ট্রেস কম অনুভূত হবে। বর্তমানে তরুণ সমাজের মধ্যে “আরে ভাবিস না এটা নিয়ে, প্যারা নাই! chill!” অনেকটাই অ্যাভয়ডার ( avoider) কোপিং স্ট্র্যাটেজির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে থাকে।
o স্ট্রেসফুল সিচুয়েশনে ঘাবড়ে না যেয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ এবং সমস্যা সমাধানের কৌশল সম্পর্কে ভাবা এবং সে অনুসারে কাজ করার মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীলতা এবং ধৈর্যশক্তি প্রকাশ পায়।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকেরা ভিন্ন ভিন্ন কিছু কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন যা কিনা ব্যক্তিকে স্ট্রেস থেকে দূরে রাখা কিংবা স্ট্রেসফুল সিচুয়েশনে মানিয়ে চলার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সেগুলো হলো-
হালকা ব্যায়াম: প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটাচলা, জগিং, ইয়োগা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, টেনিসের মতো ভাল শারীরিক অনুশীলন কার্যকরী।
রিলাক্সেশন: কেউ কেউ খুব সহজ এবং হালকা মেডিটেশনের সাহায্য নেন যেমন শান্ত পরিবেশে বই পড়া কিংবা হালকা সুরে সঙ্গীত শোনা। কেউ কেউ প্রফেশনাল গাইডের সাহায্য নিয়ে থাকেন যাদের দিক নির্দেশনার মাধ্যমে তারা মেডিটেশন করে থাকেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে স্ট্রেস কাটানোর জন্য মেডিটেশন খুবই কার্যকর বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
আত্ম-নিয়ন্ত্রণ: পূর্বের ঘটনা এবং তার ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যক্তি তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্ট্রেস কমাতে তাদের নিজস্ব আচরণ যথাযথভাবে পরিবর্তনের পাশাপাশি, লোকেরা তাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারে যাতে কিনা তারা স্ট্রেসফুল সিচুয়েশনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সমস্যা সমাধান করতে পারে।। ব্যক্তি কখনো কখনো কিছু বিশেষ মানুষ বা বিশেষ পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে পারে যা কিনা ব্যক্তিকে স্ট্রেসফুল সিচুয়েশনে ফেলে দেয়।
শেয়ারিং: স্ট্রেস উৎপন্ন করছে এমন বিষয়গুলোকে নিয়ে ব্যক্তি কথা বলতে পারেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিবার, বন্ধুবান্ধব্দের এগিয়ে আসাটা ভালো কাজে দেয়। ব্যক্তি যখন তার স্ট্রেসের বিষয়টি অন্য কারো সাথে শেয়ার করে তখন তার উপর থেকে চাপ অনেকখানি কমে যায়। এছাড়া অনেকে প্রফেশনাল সাহায্যও নিয়ে থাকেন।
টাইম ম্যানেজমেন্ট: আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সময়ের কাজ সময়ে না করে সেটিকে ফেলে রাখেন। এভাবে একের পর এক কাজ জমতে থাকে। হয়ত একসময় দেখা যায় শেষ সময়ে এসে আমরা নিজেদেরকে কাজের স্তুপের মাঝে খুঁজে পাই। বিশাল এই কাজের চাপে আমরা বেশ স্ট্রেসড আউট হয়ে যাই এবং এতে কাজগুলোও সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যায় একজন ছাত্র যে কিনা পরীক্ষার আগের রাতে সারা বছরের পড়া একসাথে পড়বার চেষ্টা করে। এসব ক্ষেত্রে সঠিক টাইম ম্যানেজমেন্ট আমাদের স্ট্রেসের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে স্ট্রেস বাকেট থিওরি টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং স্ট্রেসের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। স্ট্রেস বাকেট থিওরিতে ব্যক্তিকে একটি বালতির সাথে তুলনা করা হয় এবং ট্যাপ থেকে পড়তে থাকে পানি দ্বারা কাজ বুঝানো হয়। আমরা যদি সময়ের কাজ সময়ে না করি তবে আস্তে আস্তে বালতিটি ভর্তি হতে থাকে এবং একসময় পানির উচ্চতা বাড়তে বাড়তে বালতি থেকে পানি উপচিয়ে পড়তে শুরু করে যাকে কিনা কাজের চাপে স্ট্রেসড আউট একজন মানুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এবার যদি অন্য একটি বালতিতে একে একে কয়েকটি ছিদ্র করে দেয়া হয় তখন সেই বালতির ছিদ্রগুলো দিয়ে পানি বেরিয়ে যেতে পারে। এতে বালতিটিও আর পানি দ্বারা সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে যায়না এবং পানির উচ্চতাও বেশি বাড়তে পারেনা। এখানে প্রতিটি ছিদ্র করে দেয়া দ্বারা সময়মত কাজ করাকে বুঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ যদি আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি তবে আমাদের রূপক বালতিটিও পানি দ্বারা ভর্তি হয়না এবং আমরাও কাজের চাপে স্ট্রেসড আউট না হয়ে নিজেদের কাজগুলো সঠিকভাবে শেষ করতে পারি।
এগুলোর পাশাপাশি সাইকোথেরাপি ( কগনিটিভ থেরাপি, ইমোটিভ থেরাপি এবং স্ট্রেস-ইনোকুলেশন ট্রেনিং) দক্ষতা প্রশিক্ষণ, পরিবেশগত পরিবর্তন, শারীরিক পরিবর্তন (রক্তচাপ, মাথাব্যথার মতো শারীরিক লক্ষণ) নিয়ন্ত্রণ, ফ্যামিলি থেরাপি , গ্রুপ থেরাপি ইত্যাদিও স্ট্রেস মোকাবেলায় ব্যবহার করতে দেখা যায়।