মনের দানব

Share


মিলি তার বন্ধুদের সাথে পহেলা বৈশাখের দিন খুশি খুশি মনে ঘুরতে বের হয়েছে। রমনা বটমূলে বছরকে বরণ করে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে দিনটি  বন্ধুদের সাথে চমৎকার ভাবে কাটায় সে। কিন্তু বিকালের দিকে মিলি হঠাৎ করে তার বন্ধুদের হারিয়ে ফেলে এবং ভিড়ের মধ্যে পড়ে যায়। মিলি ভীড়ের মধ্যে কিছু দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে যারা খুবই নোংরাভাবে তার শরীরের বিভিন্ন স্থান স্পর্শ করে। মিলি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। মিলি ভিড়ের মধ্যে হাজার চিৎকার করলেও কারো সাহায্য পায়নি। এরপর পার হয়েছে বেশ কয়েক মাস। এখনো মিলির মনে সেই ঘটনাটি জীবন্ত। ঘোরের মধ্যে থাকে সে; বারবার এই ঘটনাটি মনে হতে থাকে তার এবং মনে হয় আবার বুঝি তার সাথে ঘটনাটি ঘটছে এবং ভিড়ের অবস্থান জীবন্তভাবে তার কল্পনায় ভেসে উঠে। মিলি রাস্তায় বের হলে মনে হতে থাকে এই বুঝি কেউ তার গায়ে হাত দিলো। রাতে ঘুম হয় না, ঘুমালেও মাঝেমধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখে তাকে কেউ বাজে ভাবে স্পর্শ করছে এবং স্বপ্নগুলো সত্যি মনে হয়। এইভাবে রাতে প্রায়ই ঘুম ভাঙ্গে তার। তখন মিলির ঘাম হয় ও শরীর কাঁপতে থাকে।

রুবেল উপকূলীয় এলাকায় থাকে যেখানে কয়েক বছর পরপর ঘূর্ণীঝড়ের আগমন খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। একবার রুবেলের এলাকায় ঘূর্ণীঝড় সিডর আঘাত হানে যার ফলে রুবেল তার বাবা এবং তার সর্বস্ব হারায়। এর পর খোলা আকাশের নিচে ছাড়া থাকার আর কোন উপায় ছিল না তার। সিডরের পর রুবেলের ঘুমের সমস্যা প্রকট হয়ে যায়, স্মৃতিবিভ্রম হয়, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে এবং হালকা ঝড় হলেই ভয়ে অস্থির হয়ে যায় এই ভেবে আবার হয়তো তার বাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়ে যাবে এবং সে পথে বসে যাবে। সারাক্ষণ রুবেল তাই উদ্বিগ্ন থাকে। এতে তার দৈনন্দিন জীবনেও ব্যাঘাত ঘটছে।

আমরা উপরে মিলি এবং রুবেলের যে অবস্থা দেখলাম, তাকে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি বলে। একটি দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে যখন কেউ সেই ঘটনা নিয়ে ভয় বা আশংকা অনুভব করে যেটার প্রভাব শারীরিক ও মানসিকভাবে তার ওপর পড়ে, তখন তাকে পিটিএসডি বলা হয়। সাধারণত একটি দুর্ঘটনার পর আমরা সেই ঘটনা নিয়ে কিছুদিন চিন্তা করতে থাকি। দুর্ঘটনাটি আমাদের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেললেই কি আমরা সেটিকে ডিসঅর্ডারের আওতায় আনবো?-না, দুর্ঘটনার রেশ থেকে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যপার হলেও সেটির প্রভাবে দৈনন্দিন জীবন ব্যাঘাতগ্রস্থ হওয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। দুর্ঘটনার ১ মাস পরেও যদি কোনো ব্যক্তি মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে না পারে এবং এটি যদি পরবর্তী কমপক্ষে এক মাস ধরে তার প্রতিদিনের কাজে কর্মে প্রভাব ফেলতে থাকে এবং এর সাথে সাথে বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ করতে থাকে তখনই সেটিকে আমরা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের কাতারে ফেলতে পারি।

আমরা মিলি ও রুবেলের মধ্যে যে লক্ষণগুলো দেখতে পাই যেমন ঘুমে ব্যাঘাত, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, কল্পনায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, দৈনন্দিন জীবনের ব্যাঘাত ঘটা এবং শারীরিক প্রভাব পড়া। তাদের মধ্যে সেই দুর্ঘটনার প্রচুর ফ্ল্যাশব্যাক হয়, মনে হতে থাকে আবার হয়তো তার সাথে ঘটনাটি ঘটছে। মিলির সাথে যৌন নিপীড়ন বা রুবেলের সর্বস্ব হারানোর ফলে তাদের মধ্যে ভয় ও আশংকা বিরাজ করে যার কারণে তাদের শরীরে বিভিন্ন স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ হয়। ঘাম, দ্রুত নিঃশ্বাস, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, সাময়িক উচ্চ রক্তচাপ ইত্যদি উপায়ে শারীরিকভাবে প্রভাব ফেলে। তাই বলা হয় শারীরিক ও মানসিকভাবে পিটিএসডি আক্রান্ত ব্যাক্তিরা ভুগে থাকে।  এমনকি তাদের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনা ঘটলে বা শুনলে তারা এড়িয়ে যায় বা রিএক্ট করে ফেলে কারণ ব্যাপারটা তারা সহজভাবে নিতে পারে না।

বিভিন্ন ভাবে পিটিএসডি থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন থেরাপি যেমন কগনিটিভ-বিহ্যাভিউরাল থেরাপি, এক্সপোজার থেরাপি, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট থেরাপি, হিপনোথেরাপি, রিল্যাক্সেশন থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি বা গ্রুপ থেরাপি দিয়ে থাকে। থেরাপির সাথে সাথে কাউন্সেলিং ও করা হয় যাতে করে কথা বলার মাধ্যমে সেই ব্যাক্তি হালকা অনুভব করতে পারে। নিয়মিত থেরাপি ও কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে পিটিএসডি ভালো হয়।

সবশেষে বলা যায়, পিটিএসডি আক্রান্ত ব্যাক্তি যদি পারিবারিক সাপোর্ট পায় এবং কাছের মানুষ যদি তাদের স্ট্রেসের সময় পাশে থাকে, তাহলে তাদের দৈনন্দিন জীবন সহজ হয় এবং পিটিএসডি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সহজভাবে।

(নুজহাত জাহানারা)

লোকে কী বলবে!!!

Share


হাসান অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। ছোটবেলা থেকেই একটূ লাজুক প্রকৃতির ছেলে। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানেও তেমন অংশ গ্রহণ করেনা। বন্ধুদের আড্ডায়ও চুপচাপ। আসলে কথা বলতে ভয় পায়- যদি বন্ধুরা ঠাট্টা করে বসে! ক্লাসরুমে টিচার পড়ানোর সময় কোনোকিছু বুঝতে না পারলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে ভয় পায়। ভাবে, যদি তার ক্লাসমেটরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে! অথবা যদি নার্ভাস অবস্থায় প্রশ্ন করেও বসে তখন প্রশ্ন করতে যেয়ে কথা আটকে যাওয়া কিংবা তোতলানোর ফলে শিক্ষক যদি তাকে তাচ্ছিল্য করেন! ধুর! থাক না, কী দরকার! যার ফলে আর প্রশ্ন করা হয়না। ক্লাস শেষে অনেক বিষয় নিয়েই কনফিউশন থেকে যায় হাসানের।


মৌমিতা বেশ ভালো গান গায়। আজ প্রথমবারের মত সে কলেজ ফাংশনে গান গাইবে। একটু পরেই স্টেজে তার নাম ঘোষণা হবে। কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছে। যদি গানের লিরিকস বা টোন ভুল হয়ে যায়!! কী একটা লজ্জাজনক বিষয়! স্টেজে ওঠার পর হলভর্তি মানুষ দেখে ভয়টা যেন আরো জাঁকিয়ে বসলো মৌমিতার। স্টেজে উঠে ভুল গান গাওয়া! ছিঃ ছিঃ লোকে কি বলবে! হাত পা কাঁপছে মৌমিতার, গলা শুকিয়ে আসছে, হাত থেকে মাইকটা পড়েই গেলো।

এই মৌমিতা বা হাসানের মত অনেকেই আছে যারা কিনা এইরকম জনসম্মুখে কথা বলতে কিংবা যেকোনো কাজ করতে ভয় পান কিংবা অস্বস্তি অনুভব করেন। নিজেদের মতামত কিংবা পারফর্মেন্স সম্পর্কে অহেতুক দুশ্চিন্তা করেন। যদি ভুল হয় তো মানুষ কি বলবে!!! এই টেনশন কাজ করতে থাকে নিজের ভিতর। মনোবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে আগে “সোশ্যাল ফোবিয়া” বলে উল্লেখ করলেও এখন এটিকে “সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার” নামেই অভিহিত করে থাকেন। যাদের এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার রয়েছে, তারা সামাজিক সিচুয়েশনগুলোতে নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। তারা মানুষ কি ভাববে এই নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। আমরা যদি সোশ্যাল এ্যাংজাইটির উদাহরণ নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে প্রধানত এই পাবলিক প্লেসে কথা বলা কিংবা খাওয়াদাওয়া করার কথা আসবে। স্টেজ পারফরমেন্স এর বেলায় ব্যক্তির মধ্যে এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কাজ করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। ২০০৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া অস্ট্রিয়ান লেখিকা এলফ্রিদে ইয়েলিনেক স্টকহোমের আড়ম্বরপূর্ণ নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানে আসেননি। তার সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার ছিলো বিধায় তিনি তার নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করেন একটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এতে আমরা হয়তো বুঝতে পারছি এই ডিসঅর্ডারটি যেকোনো মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে। কিন্তু এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি আমাদের কেন হয়ে থাকে?


গবেষকরা বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটির কারণ হিসেবে। তারা বলেন, এমন অনেকে আছেন যারা নিজেদের সম্পর্কে কিছু ধারণা নিজের মধ্যে লালন করেন, যেমন তারা হয়ত দেখতে আকর্ষণীয় নন কিংবা তারা যেকোনো কাজে দক্ষতার পরিচয় রাখতে পারবেন না অথবা দক্ষতার সাথে কোনো কাজ করতে গেলে তারা ব্যর্থ হবেন এবং মানুষ তাকে তার ব্যর্থতার জন্য ব্যঙ্গ করবে। তারা মনে করেন যে সামাজিক কোনো সিচুয়েশনে তার ব্যবহারের ফলে মানুষ তাকে তিরস্কার করবে। এই ধরণের নানারকম চিন্তা ভাবনা ব্যক্তির ভিতর গেঁথে যাওয়ার ফলেই মূলত এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটির সূচনা হয়।


সোশ্যাল এ্যাংজাইটি আমাদের বিশ্বে বেশ সাধারণ একটি বিষয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় আমেরিকায় প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭ জনের এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি রয়েছে। পুরুষদের চাইতে মহিলাদের এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগার হার বেশি। প্রতি ২ জন পুরুষের অনুপাতে ৩ জন মহিলা এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটির মধ্য দিয়ে যায় (ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, জানুয়ারী, ২০১৮) বাংলাদেশে এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা মানুষের হার শতকরা ৪ ভাগ। (ডেইলি স্টার, জুন, ২০১৮)


সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা মানুষজনের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলোর ভেতর কথা বলায় জড়তা অনুভব করা, নার্ভাস ফীল করা, ঘাম হওয়া, কাঁপুনি অনুভব করা  কমন। অনেক সময় বেশি সংখ্যক মানুষের সামনে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা কিংবা নাচ-গান পারফর্মের সময় দুশ্চিন্তা অনুভব হওয়া কিংবা ভয় পাওয়া বিষয়টিকে “স্টেজ ফ্রাইট” (Stage Fright) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই স্টেজ ফ্রাইটের কারণ হচ্ছে সোশ্যাল এ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার। ব্যক্তি মনে করেন যে তিনি দক্ষতার সাথে পারফর্ম করতে পারবেন না এবং দর্শকরা তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে; একজন স্টুডেন্ট মনে করে করে যে সে হয়তো ভালোভাবে তার এ্যাসাইনমেন্টটি রুমভর্তি অন্যান্য স্টুডেন্টদের সামনে প্রেজেন্ট করতে পারবে না। ফলে সে ভীত হয়ে পড়ে।


তবে সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কোনো দুরারোগ্য বিষয় নয়। গবেষকরা এর প্রতিকার বের করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা একে “এক্সপোজার থেরাপী” নামে উল্লেখ করে থাকেন যা কিনা বিভিন্ন ধরণের ফোবিয়া ট্রিটমেন্টের সময় ব্যবহার হয়ে থাকে। থেরাপিস্টরা বলেন সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা ব্যক্তিকে বেশি বেশি সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার এই অহেতুক ভয়টি তিনি কাটিয়ে উঠছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সাধারণ ভাবে হাসান কিংবা মৌমিতার মত সোশ্যাল এ্যাংজাইটিতে ভোগা মানুষদের অন্যান্য পরামর্শ দেয়া হয়। যেমন ছোট গ্রুপে কথা বলা। যেহেতু তারা পরিচিত ও খুব কম মানুষের সামনে কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেহেতু প্রথমে তাদেরকে তাদের বন্ধুদের সামনেই কথা বলতে বলা হয়। এরপর হয়তো তাদের সেই গ্রুপে এক দুইজন অপরিচিত ব্যক্তিকে আনা হয়। এরপর আস্তে আস্তে সেই সংখ্যাটি বাড়ানো হয়। একে বলে গ্রুপ থেরাপি। এভাবে আস্তে আস্তে মানুষের সামনে কথা বলতে পারা ব্যাপারটা তাকে যেকোনো সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে এ্যাংজাইটি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। গ্রুপ থেরাপিতে গ্রুপ মেম্বাররা ব্যক্তিকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার প্রশংসা করেন যাতে ব্যক্তি কথা বলতে কিংবা গান গাইতে সাহস পান। মৌমিতার মত স্টেজ ফিয়ারযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য অনেক সময় থেরাপিস্টরা আয়নার মত খুব সাধারণ একটি বিষয় ব্যবহার করেন। ব্যক্তিকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজেকে দেখে পারফরম করতে বা কথা বলতে বলা হয়। এরপর হয়তো দুই একজন মানুষের সামনে তাকে উপস্থাপন করা হয় কথা বলার জন্য। এভাবে আস্তে আস্তে সে এ্যাংজাইটি কাটিয়ে ওঠা এবং কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা ছাড়াই কথা বলা কিংবা যেকোনো কাজ করতে পারার কৌশল রপ্ত করে। আমরা বলছি না আপনি দুই-একবারের চেষ্টাতেই মোটিভেশনাল স্পীকারদের মত স্টেজ কাঁপিয়ে দিতে পারবেন। তবে এ্যাংজাইটি কাটিয়ে নিজেকে ভালোভাবে প্রেজেন্ট করতে পারাটাই এখানে বড় সাফল্য। এক্ষেত্রে সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কাটাতে ব্যক্তির চেষ্টা এবং ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে বড় উপায়। মূলত বারবার প্র্যাকটিসের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি এই সোশ্যাল এ্যাংজাইটি কেটে উঠতে পারে বলে মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা।

(আশিক মাহমুদ)

Narcissistic Personality Disorder (NPD)

Share


সূচনা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সে নিজেকে সবসময় সবচেয়ে মেধাবী, সুন্দরী, অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন  মনে করে এবং মনে করে সবাই তার গুণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। নিজের সমালোচনা সে কখনোই শুনতে চায়না। অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখায় না। সূচনা কারো সাথে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করতে ও তা রক্ষা করতে পারেনা। তার পরিবার দীর্ঘ সময় ধরে সূচনার মধ্যে বিষয়গুলো দেখেছে এবং তাকে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যায়। সেখান বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে সূচনা নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।

আজকালকার দিনে মানুষের মধ্যে নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (NPD) বা আত্মমুগ্ধতাসূচক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি প্রবলভাবে বেড়ে চলছে। নার্সিসিস্ট ট্রেইটগুলো যখন ব্যাক্তির মধ্যে স্থায়ী ও একরোখা থাকে, মনস্তাত্বিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ করে এবং ব্যাক্তির কাজে ক্ষতি করে তখন তাকে নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅরডার(NPD) বলা হয়। NPD নির্ণয় করা হবে তখন যখন ব্যাক্তির মধ্যে নিম্নোক্ত পাঁচ বা তার অধিক লক্ষণগুলো প্রকাশ পাবে। এগুলো হলো-

০১। নিজেকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া।

০২। ক্ষমতা, সাফল্য, সৌন্দর্য, শক্তি ইত্যাদি পাওয়ার মোহে আচ্ছন্ন থাকা।

০৩। অন্যের আবেগ-অনুভূতি, প্রয়োজনকে স্বীকার করতে না চাওয়া।

০৪। নিজেকে খুবই স্পেশাল মনে করা এবং শুধু উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ/প্রতিষ্ঠান তাকে বুঝতে পারে এরকম ধারনা পোষণ করা।

০৫। অহংকারী, উদ্ধত আচরণ প্রকাশ করা।

০৬। নিজেকে ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করা এবং নিজের ভুলটাকেও সঠিক বলে চালিয়ে দিতে চাওয়া।

০৭। আত্ম-সমালোচনা সহ্য করতে না পারা।

০৮। অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে না পারা।

০৯। যেকোনো আড্ডা বা সমাবেশে নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে চাওয়া।

১০। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে না চাওয়া।

১১। প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অনুভূতিহীন হওয়া।

১২। অত্যধিক প্রশংসা পাওয়ার উচ্চ বাসনা।

১৩। অন্যের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে চাওয়া ও ক্ষমতা দেখাতে চাওয়া।

১৪। বাস্তবতা সম্পর্কে কম ধারণা রাখা।



নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (NPD) পরিবেশ, সমাজ ও জিনগত কারণে হতে পারে। ছেলেদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় এটি বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে ছোটবেলায় যেসব বাচ্চা বাবা-মায়ের কাছে অবহেলিত হয় এবং অনেক শাসনে থাকে, বড় হয়ে তাদের মধ্যে NPD দেখা দিতে পারে। এছাড়া ছোটবেলা থেকে যেসব বাচ্চা খুব বেশি পজেটিভ ব্যবহার (আশকারা) পেয়ে থাকে বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তি করা সত্ত্বেও; তাদের মধ্যে এই ডিসঅর্ডারটি দেখা দিতে পারে।



ট্রিটমেন্ট-

সাইকোথেরাপি, ট্রান্সফারেন্স-ফোকাসড, মেটাকগনেটিভ থেরাপির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে তার প্রকৃত ব্যক্তিত্ব, গুণাবলি, ক্ষমতা বুঝতে সাহায্য করা হয়। NPD তে আক্রান্ত বেশিরভাগ ব্যাক্তি তাদের রোগ স্বীকার করতে চায়না। সাইকোডায়নামিক থেরাপিস্টরা এরকম মানুষকে তার সমস্যাগুলো বুঝাতে সাহায্য করে এবং তার দুর্বলতা ও প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে।


আমাদের পরিবার বা বন্ধুমহলে এমন মানুষ হয়তো আছে যারা এই নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে। সবার সাহায্য ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাই পারে তাদেরকে এই ডিসঅর্ডার থেকে বের হয়ে আসতে এবং সহানুভূতিশীল ও সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করতে।

অন্তরা অন্তু

চিন্তার কাছে দাসত্ব

Share

১)ফাইজা ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। তার বন্ধু সংখ্যা খুব কম। আরাফ সবসময় ওর সাথেই থাকে। ফাইজা মেয়েটা সবসময় সবকিছু নিয়ে Over confused  থাকে। রুটিন  থাকা স্বত্বেও আরাফকে ফোন দিয়ে কখন, কোন ক্লাস  সিওর হওয়া চাইই । প্রায়ই এমন হয় আরাফকে একটানা ২৫-৩০  বার কল দেয় ক্লাস  টাইম জানার জন্য । শুরুতে আরাফের ধারণা ছিল ওকেই শুধু এতবার কল দেয়,  বিরক্ত করে। কিন্তু ও সবাইকে  এতবার কল দেয়। ফাইজার আরেকটা সমস্যা হলো দরজার লক বার বার চেক করা। গত সপ্তাহে  Statistics ক্লাস মিস করেছে, বাসার গেইট বন্ধ করেছে কিনা তা সিওর হবার জন্য বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসায় ফিরে গিয়ে দেখে এসেছে গেইট  ঠিক মতো  বন্ধ করেছে কিনা। ফাইজা নিজের আচরণে প্রায়ই কষ্ট পায়।বাসার লোকজনও চায় ফাইজা আগের মতো হয়ে যাক।

২)আরাফের প্রতিবেশি মতিন আংকেল, কলেজের শিক্ষক। উনার একটি সমস্যা হলো বার বার হাত ধোয়া। ভদ্রলোক ৩ ঘন্টার মতো সময় নিয়ে গোছল করেন।উনার কাছে সবকিছু  অপরিষ্কার লাগে।  মোবাইল, টাকা, রিমোট ধরার পর বার বার হাত ধোয়া লাগে উনার । সহকর্মী বা বাসার সবাই উনার উপর খুব  বিরক্ত।

##ফাইজা বা মতিন আংকেল এক ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। যার নাম অবসেসিভ -কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার। যা সংক্ষেপে ওসিডি(OCD) নামে পরিচিত। যা চিন্তার কাছে দাসত্ব নামেও অবিহিত। এ রোগের লক্ষ্মণ গুলো হলোঃ

-বার বার একই কাজ বা একই চিন্তা করা,

-কোনো কাজ খুব বেশি নিখুঁত ভাবে করার চেষ্টা করা, বেশি দুশ্চিন্তা করা,

-হাত ধোয়া বার বার, ঘনঘন ঘর পরিষ্কার করা,

– পুরনো ও অদরকারি জিনিস জমিয়ে রাখা

-দরজার লক বার বার চেক করা ইত্যাদি।

কারণঃ

অনেক কারণে একজন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কারণ গুলো হলো –

১.হতাশা, মানসিক চাপ

২.বংশগত কারণেও অনেকে এ রোগে  আক্রান্ত হতে পারে

৩.মস্তিষ্কে বেশি পরিমাণে সেরোটোনিন থাকলে

৪.নিউরোট্রান্সমিটার এ ডিসফাংশন দেখা দিলে (ব্রেইন তখন বার বার একই কাজ করতে  সিগন্যাল দেয় )

চিকিৎসা:

১)মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম খুব উপকারী রোগ নিরাময়ে কারণ এর মাধ্যমে রোগী তার অবসেসিভ ব্যবহার উপলব্ধি করে।

২)ব্যক্তিগত সমালোচনা পরিহার করতে হবে,রোগীকে বুঝাতে হবে একই কাজ বার বার করার কোনো দরকার নেই।

৩)ব্রেইনের ফাংশন স্বাভাবিক করতে ঔষধ নিতে হবে

৪) কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি :রোগীর আচরণে পরিবর্তন ঘটিয়ে রোগ মুক্তি। এ থেরাপি দুভাবে কাজ করে,

এক্সপোজার – যে বিষয়ে রোগীর মনে  খুঁতখুঁতে চিন্তা আসে তার মুখোমুখি করা রোগীকে।

রোগীকে বুঝানো অযথা চিন্তা করছে তুচ্ছ বিষয় বা কাজ নিয়ে।

রেসপন্স প্রিভেনশন – রোগী যে কাজটি বার বার  করতে চায় তা করতে না দেয়া।এবং বুঝানো কাজটি বার বার করার কোনো মানে নেই ।

অনেক সময়  রোগীকে ভালো করতে আর অবসেসিভ চিন্তা দূর   ডায়েরি লিখতে বলা হয়। পছন্দের কাজ বা বন্ধুদের বেশি সময় দিতে উৎসাহ দেয়া হয় ।

লিখেছেন – তাহমিনা সুলতানা ইভা

মাইন্ডফুলনেস – বর্তমানে থাকুন

Share

সাহানা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।প্রতিদিনের হাজারো কাজের চাপে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন।এই দিশেহারা অবস্থা থেকে বের হতে তিনি নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছেন।
কক্সবাজারের সুবিশাল জলরাশী ও অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে থেকেও সাহানা অস্থির হয়ে আছেন বিভিন্ন চিন্তা নিয়ে।তিনি ভাবছেন তার এই মুহুর্তে কক্সবাজার না এসে অফিসের কাজ করা উচিত ছিল,ছুটিশেষে সে কিভাবে এতকাজ একসাথে সামলে নিবে,এছাড়া আরো কত কাজ তার পরে আছে,আগেও সে কাজে ফাঁকি দিয়েছিল যার জন্য তাকে খেসারত দিতে হয়েছিল ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে তার নিজস্ব চিন্তার জগতে হারিয়ে গেলো এবং প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তার আর উপভোগ করা হয়ে উঠলনা।

একটু ভেবে দেখুন তো আপনার সাথেও কি এরকমটা হয়?

এমন অনেক সময় হয় যে আমরা কারো সাথে কথা বলছি,বা বই পড়ছি কিন্তু আমাদের মন পড়ে আছে নিজেদের চিন্তা,আশংকা,ব্যাকুলতা,আশা-হতাশা,উদ্বিগ্নতা ভবিষ্যত নিয়ে অথবা অতীতের স্মৃতিরোমন্থন নিয়ে।আর বর্তমান সময়ে আমাদের মোবাইল ফোন,সোস্যাল মিডিয়া,মেইল,টেক্সট ইত্যাদি অতি সহজেই আমাদেরকে অন্যমনস্ক করে তোলে।প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময়গুলোতে অতীত আর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমরা আমাদের বর্তমান মুহুর্তটিতে আর মনোযোগ দিতে পারিনা।

কিভাবে অতীত ও বর্তমানের হাজারো চিন্তা থেকে মনকে সড়িয়ে বর্তমানে ধরে রাখা যায়?

“মাইন্ডফুলনেস”যা আপনাকে আত্ম-পরিবর্তন ও আত্ম-সমৃদ্ধিতে সহায্য করবে।
কোন রকম বিচার বিবেচনা না করে বর্তমান মুহুর্তটিতে সজাগ থাকাই হলো মাইন্ডফুলনেস।
বর্তমান সময়টিই আসল।কিন্তু অতীত আর ভবিষ্যতের নানাবিধ চিন্তার কারনে বর্তমান সময়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়না।মাইন্ডফুলনেস আপনাকে বর্তমান সময়ে মনোযোগী ও দক্ষতাসম্পন্ন হতে সাহায্য করবে।

মাইন্ডফুলনেস একধরনের মেডিটেশন।বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরনের মাধ্যমে মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন করানো হয়ে থাকে।প্রতিনিয়ত প্র্যাকটিস করলে মনোযোগ বর্তমান মুহূর্তে ধরে রাখা সম্ভব।মাইন্ডফুল থাকা অবস্থায় আপনি দেখতে ও বুঝতে পারবেন বিভিন্ন চিন্তার জগৎ কিভাবে আপনাকে গ্রাস করে ফেলছে।যেহেতু মাইন্ডফুল অবস্থায় ক্লিয়ার মাইন্ডে থাকা হয় সেহেতু জীবনের বিভিন্ন প্রবলেমগুলোকে সহজভাবে দেখা যায়।

কেন আপনি মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করবেন?

-মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস স্ট্রেস,এ্যাংজাইটি ও ডিপ্রেসন থেকে বের হয়ে আসতে অসাধারন ভূমিকা পালন করে।
-পর্যবেক্ষণ ও মনোসংযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
-আত্মনিয়ন্ত্রন ক্ষমতা বাড়ায়।
-মাইন্ডফুলনেস এক ধরনের মেডিটেশন যা প্রতিনিয়ত চর্চা করার ফলে আমার মতিষ্কের গঠনে পরিবর্তন আসে এবং শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
-শান্তিপূর্ণ ঘুমে এর ভুমিকা অনস্বীকার্য।
-বয়স্ক মানুষদের মধ্যে একাকীত্বতার হার কমায়।

আজকালকার দিনে যখন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারনে আমাদের মনোযোগ ও দক্ষতা সঠিকভাবে ব্যাবহার করা কঠিন হয়ে উঠছে তখন এই মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস আমাদের জন্য হতে পারে আশীর্বাদ।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন,মানসিক স্বাস্থ্য,মানসিক প্রশান্তি ইত্যাদির উপর হাতকলমে শিক্ষা দিয়ে থাকে।আর আপনার হাতে যদি সময় কম থাকে তবে ইউটিউবে মাইন্ডফুলনেস রিলেটেড ভিডিওগুলো দেখে নিতে পারেন।
মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস একবার শুরু করেই দেখুন না জীবন কতটা সুন্দর হয়ে উঠে;জীবনের স্বাদ,গন্ধ,প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করা আসলেই কতটা আনন্দদায়ক।


অন্তরা অন্তু

মন খারাপই বিষন্নতা নয়

Share

‘দোস্ত, কিছুই ভাল্লাগেনা, আমি অনেক ডিপ্রেসড!’ বর্তমান সময়ে প্রায় মানুষের মুখেই এই কথাটা শোনা যায়। কিন্তু আসলেই কি সবাই ডিপ্রেশনের শিকার?

প্রায় সময়ই আমরা মন খারাপ থাকা (sadness) এবং বিষন্নতাকে (depression) এক করে ফেলি। কিন্তু বিষয় দুটি এক নয়। মানুষের মধ্যে basic কিছু আবেগ বা emotion থাকে, sadness তার মধ্যে একটি।  আমাদের মন ভালো থাকাটা যেমন খুব স্বাভাবিক, তেমনি মন খারাপ থাকাটা‌ও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমন, আপনার কোন একটা পরীক্ষায় আপনার ফলাফল খুবই খারাপ হল। সেদিন আপনার মন খারাপ থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়? অথবা প্রতিদিনের প্রচুর ক্লাস, পড়া, টিউশন আর কাজের চাপের কারণে বা কর্মক্ষেত্রে বিরূপ পরিবেশের কারণে দিন শেষে কিছুই ভালো না লাগা। এখানে আপনার ভালো না‌ লাগার কারণ ডিপ্রেশন না, কাজের চাপ বা stress। পরবর্তীতে কাজের চাপ সামলানো শিখে গেলে আমরা অনেকটা স্বস্তি বা‌ আনন্দ বোধ করি। এখানেই মূলত মন‌ খারাপ আর ডিপ্রেশনের মধ্যে পার্থক্যটা। 

ডিপ্রেশন একটি ক্লিনিকাল ডিজঅর্ডার।  আমাদের শরীরে কোন অসুখ আছে কি না তার জন্য যেমন diagnosis দরকার, তেমনিভাবে ডিপ্রেশন নির্ণয়ের জন্যও কিন্তু diagnosis দরকার। ডিপ্রেশনের অনেকগুলো লক্ষনের মধ্যে একটি হচ্ছে sadness।  প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডিপ্রেশনের শিকার মানুষ কোন কাজেই আনন্দ খুঁজে পায়না। প্রতিদিন আড্ডা দেয়া মানুষটা ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া শুরু করে। প্রিয় সিরিজের নতুন এপিসোড রিলিজ হলে সবার মাঝে যে excitement কাজ করে, ডিপ্রেশনে থাকলে সেই excitement এর ছিটেফোঁটাও হয়ত কারও মাঝে দেখা যায়না। পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ পায়। নিজের প্রতি, নিজের জীবনের প্রতি মানুষ খুবই নেতিবাচক ও হতাশ হয়ে পড়ে এবং কাজ করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।  খাওয়া, ঘুম, প্রতিদিনের ছোট বড় কাজে মানুষ অনিয়মিত হয়ে পড়ে । মানুষ নিজের উপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই লক্ষণগুলো টানা দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে থাকলে ব্যক্তি ডিপ্রেশনে ভুগছে বলে ধরা হয়। চারপাশে ঘটে যাওয়া কিছু আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি তারা প্রায় সবাই দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশনের শিকার ছিল।

মন খারাপ ডিপ্রেশন কেন হয়?

মন‌ খারাপের কারণ আমাদের সবারই জানা। কারও সাথে মনোমালিন্য হলে, প্রিয় কোন জিনিস হারিয়ে গেলে, প্রিয় দল খেলায় হারলে ইত্যাদি কারণে আমাদের মধ্যে যে আবেগ বা ইমোশনের উদ্রেক হয়  সেটা sadness। অপরদিকে ডিপ্রেশনের কারণগুলো বেশ‌ সূক্ষ্ণ ও জটিল। বিভিন্ন মানুষের ডিপ্রেশনের কারণ ভিন্ন ভিন্ন এবং তাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ের ঘটনা বিশ্লেষণ করে কারণগুলোর বিস্তৃত ও সঠিক বর্ণনা প্রয়োজন।

মন খারাপ থাকা আমাদের প্রতিদিনের রুটিনকে বাধাগ্রস্ত করেনা, অপরদিকে ডিপ্রেশনে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম কাজ করার জন্যও যেন নিজের সাথে যুদ্ধ করা লাগে। আমাদের মন খারাপ থাকাটা সাময়িক। পছন্দের কোন কাজ করলে বা প্রিয়জনের সাথে সময় কাটালে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ডিপ্রেশন দূর করার জন্য প্রফেশনাল হেল্প বা কাউন্সেলিং দরকার।

জীবনে ভালো থাকার তাগিদ অনুভব করতে একটু আধটু মন খারাপের দরকার আছে। একটা দিন খারাপ যেতেই পারে। তাকে বিষন্নতা না ভেবে ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে জীবনকে নতুনভাবে দেখাটা জরুরি।

লিখেছেন – সামিরা

দুশ্চিন্তার সাইক্লোন

Share

কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ফয়সাল। ছোট একটি কোম্পানীতে চাকরি করছে সে। তবে তার লক্ষ্য আরো বড়। সে নিজের একটি ফার্ম খুলে সেটি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। এই বিষয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। তবে ফয়সাল সবসময়ই তার জীবনের সবকিছুকে নিয়ে অধিক পরিমাণে চিন্তা করে। তার পরিবার, তার সোশ্যাল লাইফ, তার গার্লফ্রেন্ড, তার কাজ এবং সেটির ভবিষ্যৎ, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো কত কী! তার ফ্যামিলিকে সময় দিতে পারছে কি না? গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কি না? বন্ধুরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে? তার বস এবং ক্লায়েন্টরা তার কাজে সন্তুষ্ট কি না? তবে ইদানীং তার এই চিন্তাগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে। তার শুধু মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। হয়তো তার কোম্পানী তাকে বরখাস্ত করবে, হয়তো তার ক্যান্সার বা হার্টের কোনো রোগ হয়ে যাবে, বাবা-মার স্বাস্থ্যও ইদানীং ভেঙে পড়ছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা তো একদমই হচ্ছেনা, গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঠিকমত কথা হচ্ছে না। সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে তো? নাহ, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা! নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটবে, এই হয়তো দুঃসংবাদটা আসলো। চিন্তায় আর ভালো লাগছেনা, খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে যাচ্ছে। নাহ, আর পারছেনা!

এই যে ফয়সালের এই দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ; এগুলোকেই আমরা সাধারণত এ্যাংজাইটি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। অবশ্য এ্যাংজাইটি যে কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণের জন্য হতে হবে তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই অথবা অনেকগুলো চিন্তা এক হয়ে আমাদের ভিতর একটু টেন্সড ভাব কিংবা আমাদের মধ্যে কোনো একটি বিপদের আশঙ্কা বা অস্বস্তি জাগিয়ে তোলে। এটিকে আমরা এ্যাংজাইটি বলতে পারি। এ্যাংজাইটি আমাদের নিত্যদিনের কাজ কর্মে অনেক বাধা দিতে পারে। এমন অনেক স্টুডেন্ট আছেন যারা কিনা পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে কিংবা রেজাল্ট কী হবে সেই টেনশনে পড়ালেখা শুরু করতে পারেন না। ফয়সালের যে লক্ষণগুলো আমরা দেখছি যেমন অনবরত দুশ্চিন্তা করা, কাজে মনোযোগের ব্যাঘাত, খাওয়ায় অরুচি, ঘুম কম হওয়া এগুলো সাধারণত এ্যাংজাইটি চিহ্নিত করে। আমরা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো সময়ে এ্যাংজাইটিতে ভুগছি তবে এই লক্ষণগুলো কমপক্ষে ৬ মাস বিরাজ করলে আমরা বলতে পারি একজন জেনারেলাইজড এ্যাংজাইটি ডিজর্ডারে (জিএডি) ভুগছে। জেনারেলাইজড এ্যাংজাইটি ডিজর্ডার (জিএডি) বা এ্যাংজাইটিতে ভোগা নারী ও পুরুষের অনুপাত ২:১। অর্থাৎ প্রতি একজন পুরুষের অনুপাতে দুইজন নারী এই জিএডিতে ভুগে থাকে।  ৬% মানুষ জীবনে একবার হলেও এ্যাংজাইটিতে ভুগেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণ যেমন প্রচুর ঘাম, ক্লান্ত লাগা, হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া, ঘনঘন পেটের পীড়াও জিএডির বহিঃপ্রকাশ। এ্যাংজাইটির কারণ নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও কিছু কারণ সহজেই নির্ণয় করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির কারণে মানুষ জিএডির শিকার। যেমন আমরা দেখলাম ফয়সালের বেলায় তার চাকরি, পরিবার, সোশ্যাল লাইফ, গার্লফ্রেন্ড, অর্থনৈতিক অবস্থা প্রতিনিয়ত এতো ভাবাচ্ছে যে তার সাধারন জীবনযাত্রার ছন্দপতন ঘটছে। সাধারণত জিএডিতে ভোগা মানুষেরা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হন। এবং তারা যেকোনো বিষয় নিয়েই অতিভাবনা অর্থাৎ ওভার থিংকিং করে থাকেন। এই ওভার থিংকিং হচ্ছে এ্যাংজাইটির একটি বড় কারণ। তারা সচরাচর ক্লান্তি অনুভব করেন, যেকোনো কিছুতে মনোযোগ দেওয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, উল্লেখযোগ্য হারে ঘুম কমে যায়। এ ছাড়াও এ্যাংজাইটির কারণ হিসেবে ব্রেন কেমিস্ট্রি, ব্যক্তিত্বের ধরণ ও জেনেটিক্স জড়িত। বলা হয়, ব্রেনের অ্যামিগডালার অস্বাভাবিকতার কারণে ব্রেন কেমিস্ট্রি পাল্টে যায় যেটি এ্যাংজাইটি ডিজর্ডারের কারণ।

এ্যাংজাইটি থেকে বাঁচার কিছু উপায় আছে। দুশ্চিন্তাগুলো আমরা একটি নোট খাতায় লিখে ফেলতে পারি। কিছু বিষয়ে দুশ্চিন্তা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। নোট ডাউন করার মাধ্যমে বুঝা যাবে আসলেই চিন্তাটি যৌক্তিক কিনা, অযৌক্তিক চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলা এবং যৌক্তিক চিন্তাগুলো কীভাবে সমাধানের পথে আনা যায় একটা প্ল্যান করা। দুশ্চিন্তার কারণ ঘেটে দেখা এবং কীভাবে সমাধান করা যায়-এইসব চিন্তার মাধ্যমে  দুশ্চিন্তা অনেকটুকু কমেও যেতে পারে। জীবনে একটি প্ল্যান নিয়ে এগোলেও অনেকখানি দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায়।  জীবনে ইতিবাচক বা পজিটিভ মনোভাব রাখার মাধ্যমেও এ্যাংজাইটির মাত্রা কমে আসতে পারে। মেন্টাল এক্সারসাইজ যেমন মেডিটেশন করে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। নিয়ন্ত্রিত জীবনে দুশ্চিন্তা খুব বেশি আঁকড়ে ধরতে পারে না। পজিটিভ চিন্তা দিয়ে জীবনের প্রতিকূলতা মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়। মাইন্ডফুলনেস চর্চার মাধ্যমেও এ্যাংজাইটি কমানো যায়। উপরের উপায়গুলো অনেক সময় এ্যাংজাইটি নাও কমাতে পারে। সেক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন থেরাপীর মাধ্যমে জিএডিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হন।  

সবশেষে, এ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা আমাদের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনে না। আমরা কেউই জানিনা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা জ্ঞানীর কাজ হলেও অতিরিক্ত চিন্তা এবং এই দুশ্চিন্তা কখনোই ভালো কোনোকিছুর দিকে আমাদের ধাবিত করবেনা।

লিখেছেন – নুজহাত জাহানারা

HSC Exam :The বেসামাল চাপ!

Share

(১)

‘উফ্!!এবার আর এ+ পাব না। ‘

রাব্বির তাই মনে হচ্ছে। এপ্রিল থেকে তার পরীক্ষা শুরু হবে। ভালো কলেজের মেধাবী ছাত্র সে, প্রস্তুতিও খুব ভালো। সারাবছর রাতদিন এক করে পড়ালেখা করেছে। মা-বাবার প্রত্যাশা অনেক বেশি, একমাত্র ছেলে রাব্বি। সবার কথা মাথায় রেখে সে পরিশ্রম করেছে। অথচ পরীক্ষার সাত দিন আগে থেকে কিছুই পড়তে পারছে না। ভয় আর টেনশনের ফলে রাব্বি খুব হতাশ হয়ে পড়েছে। বই নিয়ে বসলেই মনে হয়,

– যদি Golden A + না আসে তবে কি হবে?

-যদি  MCQ কঠিন হয়?

 -ICT সহজ হবে তো? আর কত কী!

রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। ঘুমাতে গেলে দুঃস্বপ্ন দেখে। তাই সারারাত জেগে কাটাচ্ছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। মা-বাবা তাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। বন্ধুরা বিরক্ত। সবারই তো পরীক্ষা। ‘রাব্বি কেন বেশি ভাব ধরছে?’-বন্ধুরা মিলে তাই ভাবছে। পরীক্ষা আসলে প্রতি বার এমন হয় তার।কিন্তু এবার বেশি টেনশনে আছে রাব্বি। সামনে যে ভর্তি পরীক্ষা!

খুব ভালো  করতে হবে। সবাই রাব্বিকে মানসিক ভাবে চাপ মুক্ত থাকার সুফল বোঝাচ্ছে। তবুও বেচারার টেনশন কমছে না।

(২)

ইমা পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত। টিউশনি করানো, বাসার কাজ সবই আগের মতোই করছে। পরীক্ষা আসলে প্রতি বার সে সব কাজ সময় মতো করার চেষ্টা করে। ইমা মনোযোগী ছাত্রী,  পড়ালেখা করে নিয়মিত। ফলে সবসময় খুবconfident থাকে। সব পরীক্ষা ভালো করবে, সে বিশ্বাস করে। সান্ধ্য আড্ডায় কম যাবে। আর টিভি দেখবে খুব কম পরীক্ষার সময়টায়। ফেসবুক চালানো বাদ দিবে। পড়ালেখা আর কাজে  ভারসাম্য আনবে। ইমা আরও বেশি নিয়মিত হবে পড়াশোনায়। পরীক্ষার চাপ তাকে  মনোযোগী করে তুলেছে।

আমরা প্রতিনিয়ত স্ট্রেস জিনিসটিকে নেগেটিভ ভাবেই দেখে থাকি। তবে আমাদের মধ্যে এই স্ট্রেস থাকাটাই স্বাভাবিক; কিন্ত খেয়াল রাখতে হবে সেই স্ট্রেসটা যেন পরিমিত পর্যায়ে থাকে। বেশি স্ট্রেসড হলে আমাদের নিত্যদিনের কাজ কর্মে ব্যাঘাত ঘটে। আবার অনেক সময় একদমই স্ট্রেস না থাকাটা আমাদের যেকোনো কাজে ডিমোটিভেট করতে যথেষ্ট। আমরা বলছি না প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে জোর করে স্ট্রেস আনতে হবে। অনেকেই আছেন যারা স্ট্রেসে থাকলে কাজ ভালো করেন। আবার অনেকে স্ট্রেসড না থাকলেই কাজে ভালো বোধ করেন। বিজ্ঞানীরা এই অপটিমাম স্ট্রেস লেভেল কে একটি গ্রাফের সাহায্যে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এখানে দেখানো হয় স্ট্রেস কিভাবে প্রোডাক্টিভিটি অর্থাৎ উৎপাদনের সাথে জড়িত। স্ট্রেস যত কম থাকে, “আরে ধুর, সমস্যা নাই, হয়ে যাবে, এত টেনশনের কিছু নাই” ইত্যাদি মনোভাব তৈরী হয়, অর্থাৎ মোটিভেশন কম থাকে, ফলে কাজ অথবা উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। আবার স্ট্রেস বেশি হলে “হায় হায় কী হবে” মনোভাব তৈরী হয়ে সমস্ত কাজটিকেই বিগড়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা গ্রাফটির মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন এই পরিমিত স্ট্রেস অনেক সময় একধরণের ভালো মোটিভেটর হিসেবে কাজ করে এবং ব্যক্তিকে প্রোডাক্টিভিটির দিকে ধাবিত করায়। পরিমিত স্ট্রেস আমাদের মধ্যে ঠিক যতটুকু টেনশন সৃষ্টি করে ঠিক ততটুকুই কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য মোটিভেট করতে থাকে। তখন আমরা কাজটি শুরু করি। সুতরাং বলা যায়, আমাদের জীবনে স্ট্রেস সম্পূর্ণ নেগেটিভ কোনো ফ্যাক্টরও নয়।

(৩)

পরীক্ষা তো কি? প্যারা নাই মামা!!

তুহিন পরীক্ষা নিয়ে মোটেও চিন্তিত  নয়। পরীক্ষা যতই কাছে আসছে সে ততই অনলাইনে থাকে। তুহিনের চিন্তায় বাসার সবাই অস্থির। মা বলেন – পড়াশোনা না করলে ছেলেটা ফেল করবে,আমি মানুষকে মুখ দেখাব কি করে!?  তাতে কি! সবার টেনশন তুহিন কে পড়ায় বসাতে পারে না। সে নিয়মিত ছবি আপলোডে ব্যস্ত। কতটা like আর react  হলো ছবিতে সে তা নিয়ে ব্যস্ত।পড়তে বসলে মনে হয় দুবছর তো আর কম পড়িনি। ভালো রেজাল্ট করতে একদিন পড়লেই হবে। So no tension, do furti।

ICT, Finance এ টেনেটুনে পাশ করেও ফাইনালে ভালো করার স্বপ্ন দেখে তুহিন। মা বাবা, বন্ধুরা যতই মোটিভেট করুক না, তাতে কোনো লাভ হয়নি।

পরীক্ষার আগে পড়লেই ভালো করা যাবে, তাই তুহিন মানসিক ভাবে কোনো চাপ অনুভব করছে না।

###উপরের গল্প গুলো থেকে বলা যায়, রাব্বি পরীক্ষা নিয়ে অনেক বেশি  চিন্তিত। সে High Stress level এ আছে। এ অবস্থায় সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে না। বেশি ভালো করার চিন্তায়, স্বাভাবিক পড়ালেখাই চালিয়ে যেতে পারছে না।পরীক্ষার সময় অনেকের  এমন হয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরীক্ষায়। যারা সব কিছুতে Stress নেয় বেশি, তাদের পক্ষে ভালো করে পড়ালেখা বা কাজ করা সম্ভব হয় না।

অপরদিকে, ইমা optimum stress level  এ আছে। এজন্য ইমার পক্ষে পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজ চালিয়ে যেতে কোনো সমস্যা হয় না। মানসিক চাপ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।  পরিমিত মানসিক চাপ  মনোযোগ বাড়ায়। ফলে মানসিক চাপ যে কাজ করার ইচ্ছে আর ক্ষমতা বাড়ায় তা প্রমাণিত হয়ে যায়।

যদি কোনো চাপ না থাকে কাজ করার সময় তবে কোনো কাজই  ভালো করে করা সম্ভব হয় না। তুহিনের বর্তমান চাপ মুক্ত চিন্তা তাকে পড়ায় মনোযোগী করতে পারছে না। মোট কথা তুহিন যদি মানসিক ভাবে পরীক্ষার জন্য চাপ অনুভব করে, তাতে পড়াশোনায় মন বসবে। তুহিন Low Stress level এ আছে, তার পক্ষে ভালো করা সম্ভব হবে না

তাই সবশেষে বলা যায়, রাব্বি কে মানসিক চাপ কমাতে হবে ভালো করার জন্য।

ইমা যেটুকু চাপ বা টেনশনে আছে তা থাকাটাই ভালো।

আর তুহিনের জন্য চাপ নেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

চাপ কমাতে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমে যেসব বিষয়ে আমরা স্ট্রেস অনুভব করি দেখতে হবে সেগুলি কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় কিনা। এর মধ্যে না বলতে শেখা অন্যতম। যেগুলি আমাদের চাপের মুখে ফেলে দিচ্ছে সেগুলিকে না করার মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই চাপমুক্ত থাকতে পারি। এমনকি যেই মানুষ আমাদের স্ট্রেসে ফেলে দেয় তাদেরও আমরা এড়িয়ে চলতে পারি যেমন পাশের বাসার আন্টি। চাইলেই আমরা আমাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করে স্ট্রেস কমাতে পারি। আমাদের স্ট্রেসের কারণ আমরা কারো সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে বা যারা আমাদের স্ট্রেসের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের জানানোর মাধ্যমে চাপমুক্ত থাকতে পারি। টাইম ম্যানেজমেন্ট করেও চাপমুক্ত থাকা যায় কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সময়মত কাজ না শুরু করার ফলে আমরা চাপে পড়ে যাই। যদি কোনভাবেই স্ট্রেস এড়ানো না যায় তাহলে স্ট্রেসের সাথে মানিয়ে নিতে পারি। স্ট্রেসের কারণ বা স্ট্রেসর কে নিজের সাথে ইতিবাচকভাবে মানিয়ে নিতে হবে। যেমন পরীক্ষার টেনসনে পড়া হচ্ছে না কিন্তু এটাও চিন্তা করা যায় যে এখন পড়তে না বসলে পরীক্ষা এমনিও খারাপ হবে তাই সময়মত পড়তে বসা যাতে পরীক্ষার ফল ভাল হয়। স্ট্রেস থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে গান শোনা, কোথাও ঘুরতে যাওয়া, বন্ধুর সাথে সময় কাটানো , আপনার যে কাজ করে আনন্দ পান সেগুলো করতে পারেন। অবশেষে যদি স্ট্রেস থেকে মুক্ত হবার কোন উপায় না পাওয়া যায় তাহলে কোন থেরাপিস্টের শরাপন্ন হতে পারেন।

সাধ্যের মধ্যে মন ভালো করার  পথ আছে। নিজেকে ভালোবাসুন, জীবন সুন্দর হয়ে যাবে রাতারাতি!!

লিখেছেন: তাহমিনা সুলতানা ইভা

কনভার্সন ডিসঅর্ডার

Share

ঘটনাঃ জনাব শহিদুল আলম একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার পদমর্যাদার কারণেই তার উপর অনেক কাজের চাপ থাকে। গত কয়েক মাস যাবত প্রতিদিন তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে প্রচণ্ড ব্যাথা হত। দিনে দিনে ব্যাথার পরিমাণ এতোই বেড়ে গেলো যে তার জন্যে অফিসে বসে কাজ করাটাও কষ্টকর হয়ে পড়েছিলো। এ সমস্যা নিয়ে তিনি একজন অর্থোপেডিকের শরনাপন্ন হলেন,অথচ ডাক্তারের পরীক্ষায় এবং মেডিকেল টেস্টে কোন সমস্যাই ধরা পড়লো না। আবার এদিকে তার পায়ের ব্যাথার অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছিলো।একদিন সকালে ঘুম ভেঙে প্রতিদিনের মত বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে শহিদুল সাহেব টের পেলেন তিনি হাঁটুর নিচ থেকে তার বাম পা নাড়াতে পারছেন না। তৎক্ষণাৎ তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন এবারও ডাক্তারের পরীক্ষায় কিংবা টেস্টে সবকিছু স্বাভাবিক আসলো। অথচ শত টেস্ট,ঔষধ দিয়েও শহিদুল সাহেব তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশে কোন অনুভূতিই ফিরে পাননি।

উপরের বর্ণনা করা করা ঘটনাটির পেছনে মুখ্য কারণ হতে পারে কনভার্সন ডিসঅর্ডার। কনভার্সন ডিসঅর্ডার হলো ব্যক্তির এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে তার ঐচ্ছিক পেশী এবং শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গসমূহতে এমন কিছু শারীরিক উপসর্গ দেখা যায় যা প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার কোন রোগের উপসর্গের সাথে মিলে না। অর্থাৎ,ব্যক্তি শারীরিক বিভিন্ন অসুবিধায় ভুগে থাকে অথচ শারীরিক উপসর্গগুলো প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার কোন রোগের সাথে মিলে না । এটিকে ফাংশনাল নিউরোলজিক্যাল সিম্পটম ডিসঅর্ডারও বলা হয়ে থাকে। এ ডিসঅর্ডারটিকে ‘কনভার্সন’ ডিসঅর্ডার বলা হয় কারণ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার মানসিক চাহিদা বা দ্বন্দ্বকে স্নায়বিক লক্ষণসমূহতে রূপান্তর করে থাকে। কনভার্সন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত আংশিক পক্ষাঘাত, অন্ধত্ব, বধিরতা- এ সকল সমস্যার বিষয়ে উল্লেখ করে থাকে। প্রকৃত শারীরিক সমস্যা থেকে এ ডিসঅর্ডারটিকে আলাদাভাবে নির্ণয় করা পারা চিকিৎসকদের জন্যেও অত্যন্ত কঠিন বিষয়। অনেক ক্ষেত্রেই আসল শারীরিক ব্যাধিই এবং কনভার্সন ডিসঅর্ডার আলাদাভাবে নির্ণয় করার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। যেহেতু আসল শারীরিক ব্যাধি এবং কনভার্সন ডিসঅর্ডারের উপসর্গের মাঝে অনেক মিল পাওয়া যায়, তাই চিকিৎসকেরা সাধারণ আসল ব্যাধির উপসর্গ এবং রোগীর বর্ণনা করা উপসর্গের মাঝে পার্থক্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন । এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তার শারীরিক উপসর্গগুলোর কারণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সাধারণত শৈশবের শেষের দিক থেকে তারুন্যের শুরুর দিকে এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে বেশি দেখা যায়।এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্তের মাঝে পুরুষদের চেয়ে মহিলারা ২ থেকে ৩ গুণ বেশি ভুক্তভোগী হয়ে থাকে।

 

 

কনভার্সন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার কারণসমূহ

কনভার্সন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার মূল কারণ এখনও নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সাধারণত মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেস, দুঃশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, মানসিক দ্বন্দ্ব, ইমোশনাল ট্রমা কিংবা বিষণ্ণতা- এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ ডিসঅর্ডারের কারণে ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে দু;শ্চিন্তাজনক বা স্ট্রেস তৈরিকারী পরিস্থিতি থেকে সাময়িকভাবে পরিত্রাণ পায়।

দ্বিতীয়ত, এই উপসর্গগুলো ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকলে দীর্ঘ সময়ব্যাপী সে স্ট্রেস তৈরিকারী পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মস্তিষ্কের স্ট্রাকচারাল, সেলুলার কিংবা মেটাবলিক কার্যক্রমের পরিবর্তন বা বাধাপ্রাপ্ত হবার কারণেও শারীরিক উপসর্গগুলো দেখা যেতে পারে। এ ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে যে শারীরিক উপসর্গগুলো দেখা যায় তা মুলত আসন্ন কোন আশংকাজনক পরিস্থিতি বা স্ট্রেস থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পাবার জন্যে শরীরের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া । উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, একজন পুলিশ অফিসার যে প্রতিনিয়ত দাগী এবং ফেরারী আসামীদের নিয়ে কাজ করে, যাকে তার কাজের প্রয়োজনে আসামীর উপর গুলি চালাতে হয়। অথচ দেখা গেলো যে গুলি চালানো কিংবা কাউকে হত্যা করার কাজটি তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু কাজের প্রয়োজনে তাকে হয়তো প্রায়ই এ কাজটি করতে হয়ে থাকে। দেখা যেতে পারে যে, যে পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যে তার শরীরের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া হিসেবে তার হাত অবশ কিংবা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। তখন এটি কনভার্সন ডিসঅর্ডার হিসেবে বিবেচিত হবে।
অনেকে অনেক ক্ষেত্রে মনে করেন যে, আক্রান্ত ব্যক্তি হয়তো তার শারীরিক সমস্যার ব্যাপারে মিথ্যা বলছেন বা বানিয়ে বলছেন। তখন তাদেরকে জোরপূর্বক এ সকল প্রতিক্রিয়া প্রকাশে বাধা দেয়া হয় অথবা তাদের কথায় গুরুত্ব দেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী উপায় তো নয়ই বরং তা দূর্দশার সৃষ্টি করে থাকে। এর উপসর্গগুলো শারীরিক মুভমেন্ট এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।

কনভার্সন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিসমূহ

  • যে সকল ব্যক্তি এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকে, তারা হলেন-
    ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি (এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত থাকে না)
  • পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি ( যে ব্যক্তি কিছু সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত আচরণ এবং অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম)
  • আগে থেকে মৃগীরোগ, কিংবা মুভমেন্ট জনিত সমস্যা থাকা
  • সাম্প্রতিক সময়ে কোন গুরুতর শারীরিক আঘাত বা মানসিক আঘাত পাওয়া
  • সম্ভবত, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস বা শৈশবে অবহেলার শিকার হওয়া
  • পরিবারে অন্য কেউ কনভার্সন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত থাকলে

কনভার্সন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হবার লক্ষণসমূহ
কনভার্সন ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো ঠিক কোন ধরণের পরিস্থিতিতে কার্যকর হয়ে উঠবে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। এটি জীবনের যে কোন সময় কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। এ উপসর্গগুলো নিজে থেকে চালু বা বন্ধও করা যায় না। এ ডিসঅর্ডারের বিভিন্ন রকম লক্ষণ থাকে বা তা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে উপস্থাপিত হতে পারে যা অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গের প্রকটতার উপরও নির্ভর করে থাকে। এর উপসর্গগুলো শারীরিক মুভমেন্ট এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। উপসর্গগুলো একবার কিংবা স্ট্রেস তৈরিকারী পরিস্থিতি বারবার উপস্থাপিত হলে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে ।

কনভার্সন ডিসঅর্ডারের উপসর্গগুলোকে মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে, যথা-
• ইন্দ্রিয়জনিত লক্ষণ
• মোটর কার্যক্রম জনিত লক্ষণ
• খিঁচুনি

ইন্দ্রিয়জনিত লক্ষণ :
ইন্দ্রিয়জনিত লক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অন্ধত্ব বা টানেল ভিশন, সাময়িক বা সম্পূর্ণ বধিরতা, ত্বকে অনুভূতি লোপ পাওয়া বা হ্রাস পাওয়া, কথা বলতে সমস্যা হওয়া বা কথা বলতে না পারা।

মোটর কার্যক্রম জনিত লক্ষণ:
মোটর কার্যক্রম জনিত লক্ষণের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে দূর্বলতা অনুভব করা, পক্ষাঘাত বা শরীরের কোন অংশে অনুভূতি না পাওয়া, শরীরের ভারসাম্যহীনতা, কোন কিছু গিলতে অসুবিধা হওয়া বা গলায় কিছু আটকে আছে তা মনে হওয়া ইত্যাদি।

খিঁচুনি:
ব্যক্তির খিঁচুনির সাথে উপযুক্ত অভ্যন্তরীণ শারীরিক প্রক্রিয়া দেখা যায় না। এক্ষেত্রে ব্যক্তির খিঁচুনির পাশাপাশি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়ে।

উপরোক্ত তিনটি শ্রেণির সংমিশ্রণে কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে যা ব্যক্তির জন্যে কষ্টদায়কও হতে পারে।

কনভার্সন ডিসঅর্ডার নির্ণয়ের উপায়সমূহ

কনভার্সন ডিসঅর্ডার মূলত Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders এর মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ণয় করা যায়। এ সকল উপায়সমূহ হলো-

  • শারীরিক মুভমেন্ট এবং ইন্দ্রিয়জনিত লক্ষণগুলো নিজে থেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা
  • নির্দিষ্ট স্ট্রেসজনিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেই শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো দেখা দেয়া
  • শারীরিক লক্ষণগুলো চিকিৎসাগতভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারা
  • শারীরিক লক্ষণসমূহ দৈনন্দিন জীবনকে বাধাগ্রস্ত করা
  • এছাড়াও ব্যক্তির কনভার্সন ডিসঅর্ডারের লক্ষণসমূহ নিশ্চিত করার জন্যে প্রয়োজনে সিটি স্ক্যান,এক্স রে, ইলেক্ট্রোয়েনসেফালোগ্রাম, রক্তচাপ পরীক্ষা করা যেতে পারে।

কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?

উপরে বর্ণিত লক্ষণগুলো যদি ব্যক্তির বর্ণনা করা লক্ষণের সাথে মিলে যায়, তবে সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এছাড়াও উক্ত লক্ষণগুলো আসলেই কোন শারীরিক বা স্নায়বিক গুরুতর সমস্যার কারণেও দেখা যেতে পারে বিধায় দেরি না করে তা নির্ণয় করে নেয়া উচিত। যদি নির্ণয় করার পর দেখা যায় যে, এটি একটি কার্যকরী নিউরোলজিক ব্যাধি, তবে তাৎক্ষণিক গৃহীত ব্যবস্থা ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলির অবস্থা উন্নত করতে পারে এবং ভবিষ্যতে সমস্যাগুলি প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

কনভার্সন ডিসঅর্ডারের কারণে সৃষ্ট জটিলতা

যদি উপযুক্ত সময়ে সঠিকভাবে কনভার্সন ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা না করা হয়, তবে সে সকল লক্ষণগুলো স্থায়ী হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এর ফলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।

কনভার্সন ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা

সাধারণত বিভিন্ন ক্লিনিকগুলোতে এ ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রধানত রোগের পেছনে দায়ী থাকা স্ট্রেসজনিত পরিস্থিতিটিকে খুঁজে বের করা হয়। এছাড়াও থেরাপিস্ট এ ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলোর প্রকটতা কমিয়ে আনার জন্যে রোগীকে উপযুক্ত ইতিবাচক প্রণোদনা দিয়ে থাকেন যার ফলে রোগী স্ট্রেসজনিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের উপসর্গের দ্বারা আক্রান্ত না হয়। এছাড়াও ব্যক্তিতে যে সকল থেরাপি দেয়া যেতে পারে, তা হলো-
• সাইকোথেরাপি
• ফিজিক্যাল থেরাপি (এটি স্ট্রেসজনিত পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট পেশীজনিত দৃঢ়তা বা খিঁচুনিকে শিথিলায়নে সহায়তা করে)
• গ্রুপ থেরাপি
• বায়োফিডব্যাক
• হিপোনসিস বা সম্মোহন থেরাপি
• রিল্যাক্সেশন থেরাপি এবং
• সাইকোট্রপিক মেডিকেশন বা ঔষধ সেবন (ডিসঅর্ডারের কারণে সৃষ্ট বিষণ্ণতা এবং উদ্বিগ্নতা দূর করতে সাহায্য করে)
উপরে উল্লেখিত উপায়গুলোর মাধ্যমে সহজেই কনভার্সন ডিসঅর্ডারকে নিরাময় বা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়ে থাকে।

কনভার্সন ডিসঅর্ডারের প্রতিরোধ

এটি সবসময় সব রোগের ক্ষেত্রেই সত্য যে, রোগ নিরাময় অপেক্ষা তা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সর্বাধিক কাম্য। কনভার্সন ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। কনভার্সন ডিসঅর্ডার প্রতিরোধের প্রাথমিক উপায় হলো স্ট্রেসজনিত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার উপায় খুঁজে বের করা এবং যথাসম্ভব উপায়ে মানসিক আঘাত এড়ানোর চেষ্টা করা। এছাড়াও আর যে উপায়ে এ ডিসঅর্ডারটি প্রতিরোধ করা সম্ভব, তা হলো-
• যে কোন মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা
• ভালো কাজ করা এবং জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা
• সকলের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করা এবং তা বজায় রাখার চেষ্টা করা
• একটি নিরাপদ ও শান্ত পারিবারিক পরিবেশ সৃষ্টি করা

উপরে উল্লেখ করা অনেক পরিস্থিতিই হয়তো আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব এসকল বিষয়গুলোকে কার্যকরীভাবে মোকাবেলা করা উচিত কারণ যারা এসকল ব বিষয়গুলোকে কার্যকরীভাবে মোকাবেলা করতে পারে তারা অনেকাংশেই তাদের চাইতে ভালো থাকে যারা বিরূপ পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে অক্ষম। সর্বোপরি, চাপ এবং মানসিক আঘাত হ্রাস করা কনভার্সন ডিসঅর্ডার প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।

অতএব, আমাদের জীবনে নানা ধরনের স্ট্রেস বা উদ্বেগজনিত পরিস্থিতি আসতেই পারে। এসকল পরিস্থিতি উপযুক্ত উপায়ে মোকাবেলা করা অথবা সময় থাকতেই কনভার্সন ডিসর্ডারের কোন লক্ষণ দেখা দিলে উপযুক্ত থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচত। আপনার সঠিক সময়ের একটি সঠিক পদক্ষেপ এ ডিসঅর্ডারে ফলে তৈরি হওয়া প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং আপনার আগামীকে করে তুলতে পারে আরো সুন্দর, স্বাভাবিক ও আনন্দময়।

লিখেছে – অধরা।

কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট: কখন কাকে প্রয়োজন?

Share

প্রফেশনাল সাইকোলজিস্টরা কেউ নিজেদের পরিচয় দেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে, আবার কেউ পরিচয় দেন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট হিসেবে। এদের মধ্যে পার্থক্য কী? মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য কার কাছেই বা যাবেন?
প্রথমে বলে নেয়া উচিত দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হতে যেমন এম. ফিল ডিগ্রি নেয়া আবশ্যক, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট হতে গেলেও তা আবশ্যক।

পার্থক্য বোঝার সুবিধার্থে শব্দদুটির মূলের দিকে তাকানো যাক। ক্লিনিক্যাল শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক ক্লাইন শব্দ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে বিছানা। অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের কাজ হচ্ছে শয্যাশায়ী, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে গুরুতর অসুস্থদের চিকিৎসা করা।

স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন জাতীয় রোগ যেগুলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে একেবারে থামিয়ে দেয়, এগুলোই হচ্ছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের ক্ষেত্র। বিভিন্ন মানসিক রোগের চিহ্নিতকরণ, চিকিৎসা, গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা। এজন্য ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের পাওয়া যায় বিভিন্ন মেন্টাল ইনস্টিটিউটে।

অন্যদিকে কাউন্সেলিং শব্দটি এসেছে ল্যাটিন কনসুলেয়ার হতে, যার অর্থ পরামর্শ দেয়া (উল্লেখ্য, কনসাল্ট শব্দটির উৎপত্তিও এখান থেকে)। ঐতিহাসিকভাবে, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টদের কাজ ছিল মানুষকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া। স্ট্রেস, সামাজিক সম্পর্ক, সিদ্ধান্ত নিতে জটিলতা এসব ক্ষেত্রে সাহায্য দিয়ে থাকেন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা। অর্থাৎ এই সেবা গ্রহণকারীরা নেসেসারিলি অসুস্থ নন। কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা কাজ করেন মানসিক রোগ প্রতিরোধে। মোটা দাগে তাঁদের কাজ হচ্ছে একটি সুস্থ জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা। এ কারণে উন্নত বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস প্রভৃতি জায়গায় কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এর প্র্যাকটিস শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে।
তবে কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টদের সাধারণ কাউন্সেলরদের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। একজন কাউন্সেলর শুধুই কাউন্সেল দেন। কাউন্সেলর হতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। মানুষের কথা শোনার ক্ষমতা থাকতে হয় এবং সেই সাথে সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে নিলেই যথেষ্ট। আর কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ। তাঁদের কাজের পরিধি ব্যাপক।
বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টদের কাজে ওভারল্যাপিং হয় প্রচুর। কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরাও রোগ শনাক্ত করেন, সাইকোথেরাপি দিয়ে থাকেন। মানসিক রোগ সংক্রান্ত গবেষণায় ভূমিকা রাখেন। আবার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরাও রোগীদের কাউন্সেল দেন। এ কারণে আজকাল অনেকে প্রস্তাব করছেন এ দুটি বিষয়ের পার্থক্য তুলে দিতে।

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ, উভয়েই এম. ফিল ধারী। কখন কার কাছে যেতে হবে সেটি নির্ভর করে মানসিক সমস্যার প্রকটতার ওপর। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখতে অথবা শুধু পরামর্শ নিতে হলেও সাইকোলজিস্টদের কাছে যাওয়ার প্রচলন বাড়ানো উচিত।

লেখা: যারিন আনজুম কথা।