তাহমিদ পানি ভয় পায়। এতটাই ভয় পায় যে কোমর পানিতে নামতেও তার প্রচন্ড ভয়, “যদি ডুবে যাই”। পানির প্রতি এই ভয়ের ফলে সে নৌকা বা লঞ্চেও চড়তে চায় না। নদী দেখলেই তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করে। সে প্রচন্ড রকমের মানসিক চাপ অনুভব করতে শুরু করে। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমাদের আজকের চরিত্র তাহমিদের রয়েছে অ্যাকুয়াফোবিয়া বা পানিভীতি। পানির প্রতি ভয় আমাদের অনেকেরই রয়েছে। সাগর বা খরস্রোতা নদী দেখে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। লিন্ডাল এবং স্টিফ্যানসনের মতে বিশ্বের ১.৮% মানুষের অ্যাকুয়াফোবিয়া রয়েছে। যাদের এই অ্যাকুয়াফোবিয়া রয়েছে তারা আসলে কি ভয় পায়? সাধারণত তারা এই ভয় পায় যে তারা ডুবে মারা যাবে কিংবা পানির স্রোতে তারা ভেসে যাবে। অনেকে ভাবে সে এমন ভয়ানক কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা হবে যা কিনা শুধুমাত্র কল্পনাই করা যায়; হয়ত পাইরেটস অফ দি ক্যারিবিয়ান কিংবা অ্যাকুয়াম্যান মুভির বিশাল অক্টোপাস “ক্র্যাকেনের” মত কোনো কিছু এসে তাকে গ্রাস করে নিয়ে যাবে। এই পানিভীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের জানতে হবে এর কারণ, লক্ষণ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে।
পানিভীতির কারণ হিসেবে মনোবিজ্ঞানীরা মূলত ব্যক্তির পূর্ব অভিজ্ঞতাকেই দায়ী করে থাকেন। হয়ত কেউ পুকুর বা নদীতে গোসল করতে যেয়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন কিংবা বন্ধুরা মিলে মজা করে পানিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে অথবা চোখের সামনে কাউকে ডুবে যেতে দেখাও পানিভীতির সৃষ্টি করে। ছোটবেলার পানি সম্পর্কিত কোনো ঘটনার আকস্মিকতা কিংবা বিপজ্জনক ঘটনার অভিজ্ঞতাই পানিভীতি তৈরী করতে পারে। আমেরিকার একটা ঘটনার কথা জানা যায়, যেখানে একটি বাচ্চা মেয়ে তার পরিবারের সাথে পিকনিকে যেয়ে একটা ঝরণার সামনে কিছু লতাপাতার ঝোপে পা আটকে যায়। সে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। তার বাবা মা তাকে সেখান থেকে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করতে পারলেও আস্তে আস্তে মেয়েটির মধ্যে অ্যাকুয়াফোবিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। পরে তাকে সাইকোলজিস্টের কাছে নেয়া হলে তার এই অ্যাকুয়াফোবিয়ার কারণ হিসেবে জানা যায় যে ছোটবেলায় সেই ঝোপে আটকে যাবার পর সামনে থাকা ঝরণার প্রবল স্রোত এবং পানির শব্দে সে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলো যে হয়ত সেই স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে এখনো পানি পড়ার আওয়াজ শুনলে কিংবা গভীর পানি দেখে সে ভয় পাচ্ছে।
ব্যক্তির অ্যাকুয়াফোবিয়ার লেভেল বা প্রাবল্য বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সাধারণত মানুষ তাদের নিজের উচ্চতার বেশি পানিকেই ভয় পায়। যে ব্যক্তি হাঁটুপানিতে বন্ধুদের সাথে মজা করছে, সেই হয়ত গলা সমান পানিতে নামলে অ্যাকুয়াফোবিক হয়ে পড়ছে। আবার কারো হয়ত পানির স্পর্শ কিংবা পানির গভীরতার কথা চিন্তা করতেই ঘাম ছোটা শুরু হয়েছে। বিভিন্নভাবে ব্যাক্তির ভেতর অ্যাকুয়াফোবিয়ার লক্ষণ বোঝা যায়। গভীর পানি দেখলে অত্যন্ত অস্বস্তিবোধ করা, বুক ধড়ফড় করা। পানির উপস্থিতি টের পেলে শ্বাস প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটা এমনকি ব্যক্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। পানির গভীরতার কথা চিন্তা করে শরীরে কাঁপুনি, ঘাম হওয়া থেকে শুরু করে প্যানিক এ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে।
অ্যাকুয়াফোবিয়ার প্রতিকার অন্যান্য ফোবিয়ার মতই। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় তিনটি উপায়ে এই ফোবিয়া থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়।
১) মডেলিং : এখানে থেরাপিস্ট নিজে পানিতে নামেন এবং অ্যাকুয়াফোবিক ব্যক্তি সেটি দেখেন। কয়েক সেশনের পর অ্যাকুয়াফোবিক ব্যক্তি নিজেও পানির ব্যাপারে সাহস পেতে শুরু করেন।
২) ফ্লাডিং: মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন একজন অ্যাকুয়াফোবিক ব্যক্তি তখনই পানিভীতি দূর করতে পারবেন যখন ব্যক্তি বারবার পানিতে নিজেকে প্রকাশ করবেন এবং বুঝতে পারবেন পানি আসলে তেমন বিপদজনক কিছু নয়। অর্থাৎ পানিভীতি দূর করতে বারবার পানির কাছে যাওয়াই হচ্ছে অ্যাকুয়াফোবিয়ার অন্যতম প্রতিকার।
৩) সিস্টেমেটিক ডিসেন্সিটাইজেশনঃ এই প্রক্রিয়াটি এক ধরণের চক্র মেনে চলে। এখানে প্রথমে থেরাপিস্ট অ্যাকুয়াফোবিক ব্যক্তিকে রিল্যাক্সেশন ট্রেনিং করান। এরপর তিনি তার সামনে কিছু ঘটনা বর্ণনা করেন এবং ব্যক্তিকে সেটি কল্পনা করতে বলেন। হয়ত প্রথমে তিনি ব্যক্তিকে সুইমিংপুলের পাশে হেঁটে যাওয়ার একটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। এরপরের ধাপে ব্যক্তি হয়ত হাত দিয়ে পানিকে স্পর্শ করছে। তার পরের ধাপে ব্যক্তি পানিতে পা ডুবিয়ে বসেছেন। এভাবে থেরাপিস্ট তার বর্ণনার মধ্যে ঘটনার ইন্টেন্সিটি বাড়াতে থাকেন এবং ব্যক্তির রিএ্যাকশন বুঝে তাকে রিল্যাক্সেশন ট্রেনিং দিতে থাকেন। এটি সাধারণত অত্যন্ত ভয়াবহ রকমের অ্যাকুয়াফোবিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একজন মানুষের অ্যাকুয়াফোবিক হওয়াটা যেমন স্বাভাবিক তেমন বিপজ্জনক। অ্যাকুয়াফোবিক ব্যক্তি তার এই পানিভীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে থেরাপিস্ট, কাউন্সিলর কিংবা প্রফেশনাল সুইমিং ট্রেইনারের সাহায্য নিতে পারেন।
আশিক মাহমুদ