কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ফয়সাল। ছোট একটি কোম্পানীতে চাকরি করছে সে। তবে তার লক্ষ্য আরো বড়। সে নিজের একটি ফার্ম খুলে সেটি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। এই বিষয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। তবে ফয়সাল সবসময়ই তার জীবনের সবকিছুকে নিয়ে অধিক পরিমাণে চিন্তা করে। তার পরিবার, তার সোশ্যাল লাইফ, তার গার্লফ্রেন্ড, তার কাজ এবং সেটির ভবিষ্যৎ, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো কত কী! তার ফ্যামিলিকে সময় দিতে পারছে কি না? গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কি না? বন্ধুরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে? তার বস এবং ক্লায়েন্টরা তার কাজে সন্তুষ্ট কি না? তবে ইদানীং তার এই চিন্তাগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে। তার শুধু মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। হয়তো তার কোম্পানী তাকে বরখাস্ত করবে, হয়তো তার ক্যান্সার বা হার্টের কোনো রোগ হয়ে যাবে, বাবা-মার স্বাস্থ্যও ইদানীং ভেঙে পড়ছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা তো একদমই হচ্ছেনা, গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঠিকমত কথা হচ্ছে না। সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে তো? নাহ, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা! নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটবে, এই হয়তো দুঃসংবাদটা আসলো। চিন্তায় আর ভালো লাগছেনা, খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে যাচ্ছে। নাহ, আর পারছেনা!
এই যে ফয়সালের এই দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ; এগুলোকেই আমরা সাধারণত এ্যাংজাইটি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। অবশ্য এ্যাংজাইটি যে কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণের জন্য হতে হবে তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই অথবা অনেকগুলো চিন্তা এক হয়ে আমাদের ভিতর একটু টেন্সড ভাব কিংবা আমাদের মধ্যে কোনো একটি বিপদের আশঙ্কা বা অস্বস্তি জাগিয়ে তোলে। এটিকে আমরা এ্যাংজাইটি বলতে পারি। এ্যাংজাইটি আমাদের নিত্যদিনের কাজ কর্মে অনেক বাধা দিতে পারে। এমন অনেক স্টুডেন্ট আছেন যারা কিনা পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে কিংবা রেজাল্ট কী হবে সেই টেনশনে পড়ালেখা শুরু করতে পারেন না। ফয়সালের যে লক্ষণগুলো আমরা দেখছি যেমন অনবরত দুশ্চিন্তা করা, কাজে মনোযোগের ব্যাঘাত, খাওয়ায় অরুচি, ঘুম কম হওয়া এগুলো সাধারণত এ্যাংজাইটি চিহ্নিত করে। আমরা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো সময়ে এ্যাংজাইটিতে ভুগছি তবে এই লক্ষণগুলো কমপক্ষে ৬ মাস বিরাজ করলে আমরা বলতে পারি একজন জেনারেলাইজড এ্যাংজাইটি ডিজর্ডারে (জিএডি) ভুগছে। জেনারেলাইজড এ্যাংজাইটি ডিজর্ডার (জিএডি) বা এ্যাংজাইটিতে ভোগা নারী ও পুরুষের অনুপাত ২:১। অর্থাৎ প্রতি একজন পুরুষের অনুপাতে দুইজন নারী এই জিএডিতে ভুগে থাকে। ৬% মানুষ জীবনে একবার হলেও এ্যাংজাইটিতে ভুগেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণ যেমন প্রচুর ঘাম, ক্লান্ত লাগা, হার্ট বিট বেড়ে যাওয়া, ঘনঘন পেটের পীড়াও জিএডির বহিঃপ্রকাশ। এ্যাংজাইটির কারণ নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও কিছু কারণ সহজেই নির্ণয় করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির কারণে মানুষ জিএডির শিকার। যেমন আমরা দেখলাম ফয়সালের বেলায় তার চাকরি, পরিবার, সোশ্যাল লাইফ, গার্লফ্রেন্ড, অর্থনৈতিক অবস্থা প্রতিনিয়ত এতো ভাবাচ্ছে যে তার সাধারন জীবনযাত্রার ছন্দপতন ঘটছে। সাধারণত জিএডিতে ভোগা মানুষেরা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হন। এবং তারা যেকোনো বিষয় নিয়েই অতিভাবনা অর্থাৎ ওভার থিংকিং করে থাকেন। এই ওভার থিংকিং হচ্ছে এ্যাংজাইটির একটি বড় কারণ। তারা সচরাচর ক্লান্তি অনুভব করেন, যেকোনো কিছুতে মনোযোগ দেওয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, উল্লেখযোগ্য হারে ঘুম কমে যায়। এ ছাড়াও এ্যাংজাইটির কারণ হিসেবে ব্রেন কেমিস্ট্রি, ব্যক্তিত্বের ধরণ ও জেনেটিক্স জড়িত। বলা হয়, ব্রেনের অ্যামিগডালার অস্বাভাবিকতার কারণে ব্রেন কেমিস্ট্রি পাল্টে যায় যেটি এ্যাংজাইটি ডিজর্ডারের কারণ।
এ্যাংজাইটি থেকে বাঁচার কিছু উপায় আছে। দুশ্চিন্তাগুলো আমরা একটি নোট খাতায় লিখে ফেলতে পারি। কিছু বিষয়ে দুশ্চিন্তা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। নোট ডাউন করার মাধ্যমে বুঝা যাবে আসলেই চিন্তাটি যৌক্তিক কিনা, অযৌক্তিক চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলা এবং যৌক্তিক চিন্তাগুলো কীভাবে সমাধানের পথে আনা যায় একটা প্ল্যান করা। দুশ্চিন্তার কারণ ঘেটে দেখা এবং কীভাবে সমাধান করা যায়-এইসব চিন্তার মাধ্যমে দুশ্চিন্তা অনেকটুকু কমেও যেতে পারে। জীবনে একটি প্ল্যান নিয়ে এগোলেও অনেকখানি দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায়। জীবনে ইতিবাচক বা পজিটিভ মনোভাব রাখার মাধ্যমেও এ্যাংজাইটির মাত্রা কমে আসতে পারে। মেন্টাল এক্সারসাইজ যেমন মেডিটেশন করে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। নিয়ন্ত্রিত জীবনে দুশ্চিন্তা খুব বেশি আঁকড়ে ধরতে পারে না। পজিটিভ চিন্তা দিয়ে জীবনের প্রতিকূলতা মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়। মাইন্ডফুলনেস চর্চার মাধ্যমেও এ্যাংজাইটি কমানো যায়। উপরের উপায়গুলো অনেক সময় এ্যাংজাইটি নাও কমাতে পারে। সেক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন থেরাপীর মাধ্যমে জিএডিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হন।
সবশেষে, এ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা আমাদের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনে না। আমরা কেউই জানিনা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা জ্ঞানীর কাজ হলেও অতিরিক্ত চিন্তা এবং এই দুশ্চিন্তা কখনোই ভালো কোনোকিছুর দিকে আমাদের ধাবিত করবেনা।
লিখেছেন – নুজহাত জাহানারা