প্যারেন্টিং স্টাইল ও সন্তানের ভবিষ্যৎ

Share

‘অমুকের ছেলে পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারলে তুমি কেন পারবে না?’- আমাদের দেশে এইরকম কথা শুনেনি এইরকম ছেলেমেয়ে পাওয়া ভার। অনেক ছেলেমেয়ে ছোটবেলা থেকেই এই কারণে হীনমন্যতায় ভোগে। বাবা মা আমাদের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী- এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সন্তানের ভালো হবে চিন্তা করে বাবা মায়েরা যা কিছু করেন তার সবই কি ঠিক?

শুধু খাদ্য, পোশাক, ভালো স্কুলে ভর্তি করানো ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা পর্যন্তই অভিভাবকের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ না।সন্তানের মনস্তত্ব সঠিকভাবে বুঝা ও তার মানসিক বিকাশের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করাও অভিভাবকের গুরুদায়িত্ব। এই প্যারেন্টিং স্টাইলের উপর সন্তানের ভবিষ্যৎ আচরণ অনেকখানি নির্ভর করে।

যেসব পিতামাতা তাদের সন্তানদের যথেষ্ঠ সময় দেন না তাদের সন্তানদের আচরণে পরবর্তীতে aggressiveness আর insecurity লক্ষণীয়। আবার সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল (over protective) বাবা মায়েদের কারণে সন্তানরা অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অনেক পিতামাতাই সন্তানের ন্যায় অন্যায় সকল আবদার পূরণ করে থাকেন। সন্তানের আবদার পূরণ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় সন্তান আরেকজনের খেলনা তার অনুমতি ছাড়াই ব্যবহারের অন্যায় জেদ করে থাকে। আর পিতামাতা তাদের এই আবদার রক্ষাও করে থাকেন। এতে করে শিশুরা অন্যের খেলনা কেড়ে নিতে শিখে। পরবর্তীতে তারা আক্রমণাত্নক, অন্যের ইচ্ছা বা আবেগের প্রতি অসহিষ্ঞু এবং অবাধ্য হয়ে উঠে।

সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা শিশুর সামাজিকীকরণে প্যারেন্টিং স্টাইলের প্রভাব নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা মূলত তিন ধরণের প্যারেন্টিং স্টাইল চিহ্নিত করেছেন।

১. Authoritarian

২. Permissive

৩. Authoritative

Authoritarian প্যারেন্টিং এ পিতামাতার প্রতি চরম আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়। শিশুদের মতামত বা ইচ্ছাকে কম মূল্যায়ন করা হয়। শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শাস্তির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে করে পিতামাতা ও শিশুদের সম্পর্ক আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার বদলে শিশুর মধ্যে ভীতি ও আনুগত্যের সৃষ্টি করে। Authoritarian প্যারেন্টিং শিশুর আত্নবিশ্বাস গঠনে বিরূপ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তী জীবনে ব্যক্তির আচরণে রাগ, বিতৃষ্ঞা, ক্ষোভ, ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে।

Permissive পিতামাতা শিশুর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেন না বরং শিশুদের নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেন। শিশুদের শাস্তির ভয় দেখিয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা বা আদব কায়দা শেখানোর পরিবর্তে এর পেছনের যৌক্তিক কারণগুলো বুঝিয়ে নিয়ম কানুন মেনে চলতে উৎসাহিত করেন। যেমন, কোন শিশু জোর করে অন্যের খেলনা নেওয়ার আবদার করলে পিতামাতা যদি ছোট বয়সেই তাদের বুঝিয়ে বলেন যে অন্যের জিনিস তার অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার করা উচিত না- তাহলে তারা তাদের আচরণে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। পরবর্তীতে তারা অন্যের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে।

মনোবিজ্ঞানীরা authoritative প্যারেন্টিং স্টাইলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। Authoritative পিতামাতা যেমন শিশুর নিজস্ব ব্যক্তিত্বকে গুরুত্ব দেন তেমনিভাবে তারা সামাজিক মূল্যবোধ শিখানোর প্রতিও যত্নশীল। Authoritative প্যারেন্টিং এ ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, মতামত, ব্যক্তিত্বকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা হয়। শিশুদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা, সামাজিকীকরণ, সফল ব্যক্তিত্ব গঠনে authoritative প্যারেন্টিং সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।গবেষণায় দেখা গেছে, authoritative প্যারেন্টিং এ বেড়ে উঠা শিশুর পরবর্তী জীবনে ডিপ্রেশন বা অপরাধ প্রবণতার হার অনেক কম।

প্রতিটি শিশু প্রাথমিক গুরুত্বপূ্র্ণ আচরণ পরিবার তথা পিতামাতা থেকেই  শিখে। তাই একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য সঠিক প্যারেন্টিং এর প্রতি পিতামাতার যত্নবান হওয়া উচিত।  -সামিরা মাহজাবিন

ফ্রাস্ট্রেশনের এপিঠ ওপিঠ

Share

“খুব ফ্রাস্ট্রেশনে আছি” আমাদের প্রতিদিনের জীবনে একটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে এই কথাটি। সাধারণত আমরা কখন ফ্রাস্ট্রেশনে থাকি? কেনোই বা ফ্রাস্ট্রেশন ঘিরে ধরে আমাদের? এই নিয়েই আজকের লেখা।

ফ্রাস্ট্রেশন কখন হয়?

সাধারণত আমরা যখন আমাদের কোনো একটি লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হই কিংবা কোনো একটি কাজ করার সময় বাধার মুখে পড়ি তখন আমরা ফ্রাস্টেশনের সম্মুখীন হই। প্রতিদিনের ঘটনাবহুল জীবনে বিভিন্ন বিষয়ের কারণেই আমরা ফ্রাস্টেশন অনুভব করতে পারি। দীর্ঘ জ্যাম, টিকেট কাউন্টারের লম্বা লাইন, বিকট শব্দে বাজতে থাকা লাউডস্পীকারের ফলে পড়াশোনায় মনোযোগ বসাতে না পারা ইত্যাদি ঘটনার কারণে আমরা প্রায় সময়ই ফ্রাস্ট্রেশন অনুভব করছি। ফ্রাস্ট্রেশনের সাথে প্রাথমিক ভাবে আমরা বিরক্তি এবং রাগ অনুভব করে থাকি। তবে সব ধরণের ফ্রাস্ট্রেশনই যে রাগের সৃষ্টি করবে তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা ফ্রাস্ট্রেশনকে একধরণের সিগন্যাল হিসেবে নিতে পারি যা কিনা আমাদের লক্ষ্যের দিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পন্থাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ কোনো এক উপায়ে কাজ সম্পন্ন না হলে অন্য কোনো উপায়ের আশ্রয় নেয়া। এতে ব্যক্তি তার সৃজনশীলতার চর্চা করতে পারে। ফ্রাস্ট্রেশন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আমাদের জীবনে আসবে এবং প্রভাব বিস্তার করবে। যেহেতু আমরা অর্জন এবং সাফল্যের দিকে নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করছি সেহেতু প্রতিটি পদক্ষেপে বাধার সম্মুখীন হওয়া এবং তা থেকে ফ্রাস্ট্রেশনের সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক।

ফ্রাস্ট্রশন কেনো হয়?

আমরা আগেই জেনেছি যে, সাধারণত মানুষ যখন কাজেকর্মে বাধা পায় কিংবা কোনো একটি লক্ষ্য অর্জনে বাধার সম্মুখীণ হয় তখন সে ফ্রাস্ট্রেশন অনুভব করে থাকে। সাইকোলজিস্টরা ফ্রাস্ট্রেশন কেনো হয় এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে অভ্যন্তরীন এবং বহিরাগত দুই ধরণের কারণ চিহ্নিত করেছেন। ফ্রাস্ট্রেশনের কারণ হিসেবে কোনো একটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসের অভাব কে অভ্যন্তরীন কারণ এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের সামাজিক অবস্থা কিংবা উক্ত লক্ষ্যের প্রতি সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য বাধা বিপত্তিকে বহিরাগত কারণ হিসেবে দায়ী করে থাকেন। এছাড়া অধিক চিন্তা, ভয়, উদ্বেগ থেকেও ফ্রাস্ট্রেশনের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ফ্রাস্ট্রেশনের রকমফের

ফ্রাস্ট্রেশন মূলত দুই প্রকার। প্রাইমারী ফ্রাস্ট্রেশন এবং সেকেন্ডারি ফ্রাস্ট্রেশন। প্রাইমারী ফ্রাস্ট্রেশন বলতে মূলত বোঝায় যখন কেউ একজন তার কোনো একটি প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনটির প্রাধান্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে ব্যর্থতাকেই ব্যক্তি বড় করে দেখেন। যেমন কেউ হয়ত পরের দিন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যক্তির কাছে এই ব্যর্থতাই তখন ফ্রাস্ট্রেশনের কারণ। সেকেন্ডারি ফ্রাস্টেশনে একটি দৃশ্যমান বাহ্যিক কারণের উপর জোর দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উক্ত ব্যক্তি যদি লাউডস্পীকারে উচ্চস্বরে গান বাজানোর কারণে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হন তখন তিনি লাউডস্পীকারের উপস্থিতির কারণে ফ্রাস্ট্রেশন বোধ করেন।

ফ্রাস্ট্রেশনের ফলে সাধারণত মানুষ বিরক্ত বোধ করে থাকে এবং সেটিকে কাটিয়ে উঠতে সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় তাদের এই আক্রমণাত্মক ব্যবহারের ফলে তারা তাদের ফ্রাস্ট্রেশনের মূল কারণ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয় এবং সেটির সমাধান তখন অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ফ্রাস্ট্রেশন থেকে মুক্তি

ফ্রাস্ট্রেশনের সমাধান হিসেবে সাইকোলজিস্টরা সাধারণত ফ্রাস্ট্রেশনের মূল কারণ কিংবা এর উৎপত্তি কে চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী কাজ করতে বলে থাকেন। ফ্রাস্টেশনের সময় রাগান্বিত না হয়ে ফ্রাস্ট্রেশনকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মেনে নিয়ে শান্ত থাকলে এবং মেডিটেশন বা অন্যান্য উপায়ে নিজেকে “শীঘ্রই ফ্রাস্ট্রেশন কেটে যাবে” এই বিশ্বাস নিয়ে পুনরায় কাজ শুরু করলে ব্যক্তি আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেন। ফ্রাস্ট্রেশন মানেই থেমে যাওয়া নয়। বরং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ফ্রাস্ট্রেশন আমাদের জন্য শাপেবর হয়ে আসতে পারে। ফ্রাস্ট্রেশনের সময় নিজের সক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখে কাজ করলে এবং কাজের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে থাকলে কাজ সম্পন্ন করার বিভিন্ন উপায় সামনে আসতে পারে যা ব্যক্তির ব্যবস্থাপনামূলক দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার দিকটিকে ফুটিয়ে তোলে।

আশিক মাহমুদ

মায়ের মনখারাপ

Share

রিনার বাচ্চার বয়স এক মাস হলো। পরিবারে এখনো নবজাতকের আগমনের উৎসব চলছে। সবার আকর্ষণ কেন্দ্র এই বাচ্চা। মা হতে পেরে রিনা খুব খুশি হলেও কিছুদিন হলো তার মেজাজ খিটখিটে। তার কিছুই ভাল লাগে না,সারাদিন মন খারাপ থাকে, প্রায়ই কান্না করে এমনকি বাচ্চার কাজ করতেও বিরক্ত লাগে ইদানিং। রিনা তার আকস্মিক পরিবর্তন বুঝতে পারলেও কিভাবে কার কাছে যাবে বুঝতে পারে না। সাথে তার পরিবারের কেউ তাকে বুঝতে চেষ্টা করে না। হঠাৎ একদিন রিনার বান্ধবী তার বাসায় আসে। রিনার ক্লান্তি মাখা চেহারা দেখে তিনি রিনাকে তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সব কথা শোনার পর উনি বুঝতে পারেন রিনা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগছে।

লক্ষণ:
রিনার অবস্থাকে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বলা হয়। পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন সন্তান জন্মের ২ বা ৩ সপ্তাহ পর দেখা দেয়। প্রথমে মনখারাপ, মেজাজ খিটখিটে হয় যেটাকে বেবি-ব্লু বলা হয়। কিন্তু এই লক্ষণ গুলো যখন তীব্র হয়ে যায় এবং এর সাথে আরো অনেক লক্ষণ যোগ হয় যেমন উদ্বেগ, হতাশা, নিজের ও আশেপাশের মানুষের উপর রাগ এবং তাদের এড়িয়ে চলা, প্রচন্ড মুড সুইং, প্রায়ই কান্না করা ইত্যাদি।

রিনার অবস্থাকে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বলা হয়। পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন সন্তান জন্মের ২ বা ৩ সপ্তাহ পর দেখা দেয়। প্রথমে মনখারাপ, মেজাজ খিটখিটে হয় যেটাকে বেবি-ব্লু বলা হয়। কিন্তু এই লক্ষণ গুলো যখন তীব্র হয়ে যায় এবং এর সাথে আরো অনেক লক্ষণ যোগ হয় যেমন উদ্বেগ, হতাশা, নিজের ও আশেপাশের মানুষের উপর রাগ এবং তাদের এড়িয়ে চলা, প্রচন্ড মুড সুইং, প্রায়ই কান্না করা ইত্যাদি।

কারণ:
মা হওয়ার পর শারীরিক, মানসিক ও বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একজন নারীকে যেতে হয়। শরীরের বিভিন্ন ধরণের হরমনের উঠা-নামার ফলে মূলত একজন মা এই অনুভূতির ভিতর দিয়ে যায়। এর সাথে যোগ হয় মায়ের দায়িত্ব পালন, নির্ঘুম রাত ও পরিবারের থেকে এক ধরণের দায়িত্ব পালনের চাপ ও প্রত্যাশা। এগুলো নতুন মায়ের মধ্যে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের সূচনা করে।

প্রতিকার:
প্রথমে পরিবারের সদস্যদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সাপোর্ট একজন মায়ের জন্য খুবই জরুরী এবং অনেক সময়ই পারিবারিক সাপোর্টের কারণেই একজন মা এই পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন থেকে কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যে লক্ষণগুলো উপরে বলা হলো তা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়, ২ সপ্তাহ অতিক্রম করে, প্রতিদিনের কাজে বাধা হয়ে দাড়ায় এবং আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা থাকে (খুবই কম ) তাহলে অবশ্যই প্রোফেশনাল হেল্প বা মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।

এতক্ষণ মায়েদের কথা বললেও বাবারাও এর থেকে মুক্ত নয়। বাবাদের মধ্যেও এই লক্ষণগুলো দেখা যায় কারণ মায়েদের সাথে তাদেরও জীবনে পরিবর্তন আসে।

প্রায় প্রত্যেক মায়েরাই  পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে যায় যেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। পারিবারিক সহযোগিতাই পারে মায়ের মন ও স্বাস্থ্য ভাল রাখতে। তাই পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতামূলক আচরণ করা উচিত। 

ভালো রাখি মায়েদের।

নুজহাত জাহানারা

মনঋতুর আদ্যোপান্ত

Share

গত লেখায় আমরা জেনেছিলাম ইউনিপোলার ডিপ্রেশন সম্পর্কে। এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় সময়ই শুধুমাত্র ডিপ্রেসনে ভুগে থাকেন। কিন্তু যদি আক্রান্ত ব্যক্তিটি কখনো অত্যন্ত ডিপ্রেশন আবার কখনো অত্যন্ত আনন্দিত অবস্থায় থাকে তখন আমরা সেটাকে কি বলতে পারি? মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তির এই মানসিক অবস্থার নাম দিয়েছিলেন “ম্যানিয়াক ডিপ্রেশন”; পরে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “বাইপোলার ডিসঅর্ডার”।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত কারা?

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যাক্তি উপর্যুপরি প্রচন্ড রকমের মুড সুইং এর শিকার হন। কখনো অত্যন্ত ডিপ্রেসড থাকেন; এতটাই ডিপ্রেসড থাকেন যে ব্যক্তি আত্মহননের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে পারেন আবার কখনো একজন ম্যানিয়াকের মত আচরণ করেন (ম্যানিয়া হচ্ছে ডিপ্রেশনের ঠিক উল্টো একটি অবস্থার নাম। এই পর্যায়ে ব্যক্তি অত্যন্ত উৎফুল্ল বোধ করেন)। ব্যক্তি তার এই ডিপ্রেশন কিংবা ম্যানিয়া ফেজটিতে সপ্তাহ কিংবা কখনো মাসব্যাপী অবস্থান করেন। মূলত ব্যক্তি এই দুই ধরণের অবস্থার মধ্যে প্রতিনিয়ত বসবাস করতে শুরু করেন বলেই একে বাইপোলার নামে অভিহিত করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানী ওয়াইনরেবের ভাষায় বাইপোলার ডিসঅর্ডার মূলত আমাদের মস্তিষ্কের একটি সমস্যা যা কিনা আমাদের মানসিক অবস্থার ওঠানামা করার জন্য দায়ী। এই ওঠানামা এতটাই প্রকট হয় যে, এটি আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে যথেষ্ঠ ব্যাঘাত ঘটাতে সক্ষম। মানসিক সমস্যার তীব্রতার উপর ভিত্তি করে বাইপোলার ডিসঅর্ডারকে দুইটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ১) বাইপোলার ১ ডিসঅর্ডারঃ এখানে ব্যক্তি কমপক্ষে একবার ম্যানিয়া এবং তার আগে ডিপ্রেশন ফেজের মুখোমুখি হন। ২) বাইপোলার ২ ডিসঅর্ডারঃ এখানে ব্যক্তি একাধিকবার ডিপ্রেশনের শিকার হন এবং কমপক্ষে একবার হাইপো ম্যানিয়া ফেজে অবস্থান করেন। হাইপো ম্যানিয়াক ব্যক্তির ঘুম কম হয় এবং অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকেন। এছাড়া উৎফুল্লতা এবং প্রতিযোগী মনোভাব পোষণ করেন। তিনি প্রায়ই মিশ্র রকমের অনুভূতি অনুভব করেন। দুই ধরণের ক্যাটাগরিতেই ব্যক্তি প্রচন্ড রকমের মুড সুইং এর মধ্য দিয়ে যান।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১) ম্যানিয়াক সিম্পটম-

  • অদ্ভুত বোধ করা।
  • উদাস কিংবা একঘেয়েমিতা।
  • বিভ্রান্ত বোধ করা।
  • উৎফুল্ল ব্যক্তির মনে হয় যে তারা যে কোনো কিছুই করতে পারেন এবং এই চিন্তা থেকে তারা বিপদজনক কাজ করে বসতে পারেন।
  • ব্যক্তির আচরণে হঠাৎ করে চিন্তার উদয় হওয়া আবার হঠাৎ ই সেটি মিলিয়ে যেয়ে নতুন কোনো চিন্তার উদয় হওয়া।
  • চঞ্চলতা কিংবা কখনো আক্রমনাত্মক ব্যবহার দেখা দেয়।

২) ডিপ্রেশন সিম্পটম

  • হতাশা
  • নিজেকে দোষী এবং ব্যর্থ মনে করা
  • উদ্বিগ্নতা
  • ঘুমের ব্যাঘাত
  • দুঃখী মনোভাব
  • বিরক্তিবোধ, ইত্যাদি।

ম্যানিয়াক ব্যাক্তি কখনো নিজেকে অত্যন্ত সফল এবং সুখী ভাবেন আবার হঠাৎই ডিপ্রেশন ফেজে হতাশায় নিমজ্জিত হন। কমপক্ষে সাত দিন থেকে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে দুইধরণের লক্ষণই বারবার দেখা গেলে ব্যাক্তি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া যায়।

কি কারণে বাইপোলার ডিসঅর্ডার হতে পারে?

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণ হিসেবে মূলত বিজ্ঞানীরা আমাদের মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যক্রমকে চিহ্নিত করেছেন। নোরেনেফ্রিন হরমোনের অধিক ক্ষরণের ফলে ম্যানিয়া এবং স্বল্প সেরোটোনিন ক্ষরণের ফলে ডিপ্রেশন ফেজের উৎপত্তি হয়। কিছু গবেষক নিউরন মেমব্রেনের ভেতরে এবং বাইরে আয়নের অস্বাভাবিক চলাচল এবং জেনেটিক এ্যাবনর্মালিটিকে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের জন্য দায়ী করছেন।

তবে সুখের বিষয় হচ্ছে বাইপোলার ডিসঅর্ডার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলেও এটি সমাধানযোগ্য। বাইপোলার ডিসঅর্ডার ট্রিটমেন্টের প্রধান লক্ষ্য থাকে ম্যানিয়াক এবং ডিপ্রেশন ফেজের পুনরাবৃত্তির হার কমানো। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীর অবস্থা অনুযায়ী তাকে এ্যান্টিসাইকোটিস মেডিসিন কিংবা কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপী কিংবা ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপীর আওতায় আনেন। সঠিক সেবার মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে রোগীর অবস্থার উন্নতি দেখা যায়।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার সহ অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত তাদের অসুস্থতা প্রকাশের আশঙ্কায় থাকেন কারণ তারা মনে করেন যে তারা সমাজের দ্বারা প্রত্যাখাত হতে পারেন কিংবা পাগল বলে অভিহিত হতে পারেন। এই ভয়টি আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা গ্রহণ থেকে বিরত করতে পারে যা তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দেয়। লিন্ডন (২০১১) এর মতে, দুই ধরণের ভয় কাজ করে; সাধারণ মানুষের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীর প্রতি ভয় এবং রোগীর নিজের ভয়। রোগীর নিজের ভয় থাকে মূলত নিজেকে নিয়ে উৎপন্ন হতাশা এবং স্বল্প আত্মমর্যাদা।  যে ব্যক্তি উভয় ধরণের ভয়ে  ভুগছেন তিনি নিঃসন্দেহে মানসিক সাহায্য এবং প্রিয়জনের সমর্থন না পেলে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন না। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের আরো বেশি সহানুভূতিশীল হতে হবে।

-আশিক মাহমুদ