মনঋতুর আদ্যোপান্ত

Share

গত লেখায় আমরা জেনেছিলাম ইউনিপোলার ডিপ্রেশন সম্পর্কে। এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় সময়ই শুধুমাত্র ডিপ্রেসনে ভুগে থাকেন। কিন্তু যদি আক্রান্ত ব্যক্তিটি কখনো অত্যন্ত ডিপ্রেশন আবার কখনো অত্যন্ত আনন্দিত অবস্থায় থাকে তখন আমরা সেটাকে কি বলতে পারি? মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তির এই মানসিক অবস্থার নাম দিয়েছিলেন “ম্যানিয়াক ডিপ্রেশন”; পরে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “বাইপোলার ডিসঅর্ডার”।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত কারা?

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যাক্তি উপর্যুপরি প্রচন্ড রকমের মুড সুইং এর শিকার হন। কখনো অত্যন্ত ডিপ্রেসড থাকেন; এতটাই ডিপ্রেসড থাকেন যে ব্যক্তি আত্মহননের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে পারেন আবার কখনো একজন ম্যানিয়াকের মত আচরণ করেন (ম্যানিয়া হচ্ছে ডিপ্রেশনের ঠিক উল্টো একটি অবস্থার নাম। এই পর্যায়ে ব্যক্তি অত্যন্ত উৎফুল্ল বোধ করেন)। ব্যক্তি তার এই ডিপ্রেশন কিংবা ম্যানিয়া ফেজটিতে সপ্তাহ কিংবা কখনো মাসব্যাপী অবস্থান করেন। মূলত ব্যক্তি এই দুই ধরণের অবস্থার মধ্যে প্রতিনিয়ত বসবাস করতে শুরু করেন বলেই একে বাইপোলার নামে অভিহিত করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানী ওয়াইনরেবের ভাষায় বাইপোলার ডিসঅর্ডার মূলত আমাদের মস্তিষ্কের একটি সমস্যা যা কিনা আমাদের মানসিক অবস্থার ওঠানামা করার জন্য দায়ী। এই ওঠানামা এতটাই প্রকট হয় যে, এটি আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে যথেষ্ঠ ব্যাঘাত ঘটাতে সক্ষম। মানসিক সমস্যার তীব্রতার উপর ভিত্তি করে বাইপোলার ডিসঅর্ডারকে দুইটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ১) বাইপোলার ১ ডিসঅর্ডারঃ এখানে ব্যক্তি কমপক্ষে একবার ম্যানিয়া এবং তার আগে ডিপ্রেশন ফেজের মুখোমুখি হন। ২) বাইপোলার ২ ডিসঅর্ডারঃ এখানে ব্যক্তি একাধিকবার ডিপ্রেশনের শিকার হন এবং কমপক্ষে একবার হাইপো ম্যানিয়া ফেজে অবস্থান করেন। হাইপো ম্যানিয়াক ব্যক্তির ঘুম কম হয় এবং অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকেন। এছাড়া উৎফুল্লতা এবং প্রতিযোগী মনোভাব পোষণ করেন। তিনি প্রায়ই মিশ্র রকমের অনুভূতি অনুভব করেন। দুই ধরণের ক্যাটাগরিতেই ব্যক্তি প্রচন্ড রকমের মুড সুইং এর মধ্য দিয়ে যান।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১) ম্যানিয়াক সিম্পটম-

  • অদ্ভুত বোধ করা।
  • উদাস কিংবা একঘেয়েমিতা।
  • বিভ্রান্ত বোধ করা।
  • উৎফুল্ল ব্যক্তির মনে হয় যে তারা যে কোনো কিছুই করতে পারেন এবং এই চিন্তা থেকে তারা বিপদজনক কাজ করে বসতে পারেন।
  • ব্যক্তির আচরণে হঠাৎ করে চিন্তার উদয় হওয়া আবার হঠাৎ ই সেটি মিলিয়ে যেয়ে নতুন কোনো চিন্তার উদয় হওয়া।
  • চঞ্চলতা কিংবা কখনো আক্রমনাত্মক ব্যবহার দেখা দেয়।

২) ডিপ্রেশন সিম্পটম

  • হতাশা
  • নিজেকে দোষী এবং ব্যর্থ মনে করা
  • উদ্বিগ্নতা
  • ঘুমের ব্যাঘাত
  • দুঃখী মনোভাব
  • বিরক্তিবোধ, ইত্যাদি।

ম্যানিয়াক ব্যাক্তি কখনো নিজেকে অত্যন্ত সফল এবং সুখী ভাবেন আবার হঠাৎই ডিপ্রেশন ফেজে হতাশায় নিমজ্জিত হন। কমপক্ষে সাত দিন থেকে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে দুইধরণের লক্ষণই বারবার দেখা গেলে ব্যাক্তি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া যায়।

কি কারণে বাইপোলার ডিসঅর্ডার হতে পারে?

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণ হিসেবে মূলত বিজ্ঞানীরা আমাদের মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যক্রমকে চিহ্নিত করেছেন। নোরেনেফ্রিন হরমোনের অধিক ক্ষরণের ফলে ম্যানিয়া এবং স্বল্প সেরোটোনিন ক্ষরণের ফলে ডিপ্রেশন ফেজের উৎপত্তি হয়। কিছু গবেষক নিউরন মেমব্রেনের ভেতরে এবং বাইরে আয়নের অস্বাভাবিক চলাচল এবং জেনেটিক এ্যাবনর্মালিটিকে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের জন্য দায়ী করছেন।

তবে সুখের বিষয় হচ্ছে বাইপোলার ডিসঅর্ডার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলেও এটি সমাধানযোগ্য। বাইপোলার ডিসঅর্ডার ট্রিটমেন্টের প্রধান লক্ষ্য থাকে ম্যানিয়াক এবং ডিপ্রেশন ফেজের পুনরাবৃত্তির হার কমানো। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীর অবস্থা অনুযায়ী তাকে এ্যান্টিসাইকোটিস মেডিসিন কিংবা কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপী কিংবা ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপীর আওতায় আনেন। সঠিক সেবার মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে রোগীর অবস্থার উন্নতি দেখা যায়।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার সহ অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত তাদের অসুস্থতা প্রকাশের আশঙ্কায় থাকেন কারণ তারা মনে করেন যে তারা সমাজের দ্বারা প্রত্যাখাত হতে পারেন কিংবা পাগল বলে অভিহিত হতে পারেন। এই ভয়টি আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা গ্রহণ থেকে বিরত করতে পারে যা তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দেয়। লিন্ডন (২০১১) এর মতে, দুই ধরণের ভয় কাজ করে; সাধারণ মানুষের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীর প্রতি ভয় এবং রোগীর নিজের ভয়। রোগীর নিজের ভয় থাকে মূলত নিজেকে নিয়ে উৎপন্ন হতাশা এবং স্বল্প আত্মমর্যাদা।  যে ব্যক্তি উভয় ধরণের ভয়ে  ভুগছেন তিনি নিঃসন্দেহে মানসিক সাহায্য এবং প্রিয়জনের সমর্থন না পেলে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন না। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের আরো বেশি সহানুভূতিশীল হতে হবে।

-আশিক মাহমুদ

Loved this article? Share with your community and friends.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share